Code

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

Second Header

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

Monday, November 16, 2015

কেমন আছো তুমি - অষ্টম পর্ব

"দারুণ লাগছে, কথাগুলো প্রাঞ্জল হয়ে উঠছে প্রতিটা লাইনে। আর যত শুনছি ততই আরও আগ্রহ বেড়ে যাচ্ছে.........(একটু থেমে) তোমার প্রতি।" শ্যামল শুধুমাত্র লাজুকভাবে হেসেছিল বছর পঁইত্রিশের সেই গ্ল্যামার তনয়ার দিকে, আর অত্যন্ত সন্তর্পণে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল তাকে। হয়তো শব্দের উষ্ণতা আঁচ করতে পেরেছিল শ্যামল, আর তাই বলল "ভালো লাগল তোমার সাথে কথা বলে। কিছু মাইন্ড না করলে, আমি একটু আসছি, আমার কিছু বন্ধু অপেক্ষা করছে..."

"ওহ! সিওর", সদ্য প্রেমে পড়া সেই মহিলা ফ্যানের নেশাতুর চিকচিকে ঠোঁট বেয়ে নেমে এসেছিল এই দুটো কথা। মনে হয়, আরও কিছুক্ষণ কথা বলতে চেয়েছিল তার মন, কিন্তু ছেড়ে দিতেই হল। জানালার বাইরে তখন আবছা কুয়াশায় শহর বেশ জবুথবু, কিন্তু কাঁচের এপারে, কথায় বার্তায়, কফির নরম চুমুকে শুধুই উষ্ণতার ছোঁয়া। 

অন্য সকল মানুষের মতই তার মনও হয়তো বুঝতে পেরেছিল, এই ছেলেটার অস্ফুট কথা, তার জীবনের ক্যানভাসে ছোট ছোট তুলির টানের গল্প। আর সেই অনুভব বইয়ের পাতা ছাড়িয়ে, মনের অনেক কাছাকাছি পৌঁছে গেছিল বলেই............

"খুব ভালো লিখেছিস...কিন্তু তোর কি মনে হয়না, এই জোন টা থেকে তোর বেরিয়ে আসা উচিত।", চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল নবারুণদা। সঙ্গে সহেলিদি, আকাশ, ইউসুফ আর পাপিয়া। ওরা সবাই এসেছে শ্যামলের আমন্ত্রণে।

"দেখ, আমি তোর লেখা পড়েছি, আমার বেশ ভালো লাগে, কিন্তু আমি চাই তুই একটু অন্য কিছু নিয়েও ভাব...নাহলে...হয়ত রসদ কমে যাবে খুব শিগগিরি। প্রেম নিয়ে তো..."

শ্যামল নবারুণদার কথাটা একটু থামিয়ে বলল, "আমি লেখার জন্য লিখি না দাদা, আশা করি, তুমি এতদিনে সেটা বুঝে গেছ। আমি ভালোবাসি, তাই লিখি। লেখা আমার জীবিকা নয়, আর জানিও না আমার আদর্শ জীবিকা কি হওয়া উচিত ছিল। ব্যাঙ্গালোর-এর এমএনসি এর চাকরিটা আমাকে কিউবিকলের চার সীমানায় বেঁধে ফেলছিল। আমি একটু শ্বাস নিতে চাইছিলাম। তাই এক রকম জোর করেই....."

একটু থেমে আবার বলে উঠল আপনমনে, "ওকে আজও ভালোবাসি। তাই হয়তো এটা নেশার মতো হয়ে গেছে। আর জোন! হ্যাঁ, বলতে পারো। লেখাগুলো ঠিক ওই সময়েই আসে। কখনও ভেবে দেখেছো একটা মানুষের দিন রাত্রি, মিনিট সব কিছু জুড়ে ফেললে কত বড় একটা গল্প হতে পারত? আমি তো শুধু মাত্র আমারই কিছু টুকরো স্মৃতিকে ভাগ করে নিচ্ছি। প্রতিদিন, নতুন মানুষ, নতুন আবহ, নতুন সম্পর্ক, কত গল্প ছড়িয়ে আছে আমার চারপাশে। শুধু মুঠো বন্ধ করে কুড়িয়ে নিলেই হল।"

পাপিয়া হেসে বলল, "আর প্রেম?সেটা তো সব সময়েই তোর লেখায় এসেছে। সেটাও কি সর্বক্ষণ..."

পাপিয়া শ্যামলের লেখিকা বন্ধু, তাই এক রকম অনুযোগের সুরেই বলল শ্যামল, "অস্বীকার করা ভুল হবে। কিন্তু যে সমস্ত ঘটনা আমাকে রোমন্থন করতে বাধ্য করে সেখানেই ওর কথা ফিরে আসে।"

"কিন্তু, ও তো এখন আর......"

কথাটা শুনে শ্যামল একটু অস্বস্তি বোধ করল, "থাক না পাপিয়া। জানিস, যেদিন ওকে ভুলে যাব, সেদিন হয়তো অন্য শ্যামলকে দেখবি তুই। একেবারে অন্যরকম। "

"বদলাস না রে। যেমন আছিস তেমনি থাক... হয়তো তুই বেঁচে থাকবি, কিন্তু শ্যামল মরে যাবে..."

সহেলিদি একরকম নীরবতা ভেঙে বলল, "আচ্ছা, প্রেমিক বাবু, বিয়েটা কবে করবি? অনেক তো হল।"

শ্যামল মুচকি হেসে, "ভালোবাসাটা আগে হোক? বৃথা আশা মরিতে মরিতেও মরে না।"

পার্ক ষ্ট্রীটের এক রুপোলী সন্ধ্যা। নাহ, সপ্তাহের মাঝেরই কোনও একটা দিন; অবশ্য সাদা বাড়িটার সামনে জমতে থাকা মানুষজন দেখলে সেটা মনে হবে না। রিডার'স কর্নারের সামনে ব্যস্ততার শেষ নেই; সিকিউরিটি গার্ড বারে বারে রাস্তা ফাঁকা করে দেবার চেষ্টা করছে। ঘন ঘন কিছু লোকের আসা যাওয়া। একটু নজর রাখলে মিডিয়ার কিছু চেনা মুখের আনাগোনাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আর সকলের মধ্যমণি ওই একজন; যার কথা, গল্প আর স্মৃতি শুনতে এসেছে সকলে।

প্রায় পাঁচ বছর হয়ে গেল, চাকরিটা ছেড়েছে শ্যামল। পারিবারিক অবস্থাও খুব একটা ভালো ছিল না, সেসময়। এক রকম জোর করে বেড়িয়ে এসেছিল মিটিং, ডেডলাইন, ক্লায়েন্ট কল, টার্গেট- এর সীমানা ছাড়িয়ে। লেখাকে জীবিকা করবে এটা কখনই ভাবেনি। অবশ্য আজও এটা ওর জীবিকা নয়। পারিবারিক ব্যাবসা এখন ওই দেখা শোনা করে, বাবা মারা যাবার পর। কোলকাতায় পরিবারের কাছে থাকে বলে, লেখালিখিতে আরও বেশি সময় দিতে পারে। হয়তো প্রশ্ন উঠতে পারে, কেনই বা
একটা ছেলের "জীবিকা" নির্বাহ করার অক্ষমতাকে তার লেখনী প্রতিভা দিয়ে ঢাকা হবে। অবশ্যই সঙ্গত প্রশ্ন, কিন্তু হয়তো "নীড় ছাড়া" কিছু পাখির মতো তারও ইচ্ছে ছিল জীবনের রেগুলার রুটিন থেকে বেড়িয়ে আসার। সেটাই বা কম কি?

পিছনের গেট দিয়ে বেড়িয়ে, একটু নির্জনতা খুঁজছিল শ্যামল, তাই বড় বাড়িটার লাগোয়া একটা চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে চুপ করে সিগারেটের ধোঁয়ায় নিজেকে আবিষ্ট করে রাখল কিছুক্ষণ। আর্থিক অবস্থা সচ্ছল হয়েছে এখন, কিন্তু সাদামাটা পোশাক-আসাক এখনও রয়েই গেছে। অর্পিতা সিগারেটের ধোঁয়া একটুও পছন্দ করত না। এই নিয়ে ওদের মধ্যে কম ঝগড়া-খুনসুটি হয়নি। এখন তাই সেই ঘন ধোঁয়ায় প্রতিটি নিঃশ্বাসে মনে মনে তাকে কষ্ট দিতে চায় শ্যামল। এই অবাধ্যতার মধ্যে দিয়েই সে যেন ভাবতে চায়, সে বেঁচে উঠতে পারে অর্পিতাকে ছাড়া।

একটু ছোট কফি বিরতির পর, আবার হলরুম বেশ গমগম করতে লাগল। বেশ কিছু নতুন মুখ অবশ্যই। শ্যামল চেয়ারে এসে বসে, আরেকবার দেখে নিল আগ্রহী চোখগুলো। এটা ভাবতেই তার কিরকম যেন একটা শিহরণ জাগল, "সত্যিই আমার লেখা এতোগুলো মানুষকে ছুঁয়ে গেছে?" শুধু মুগ্ধতা নয়, অনেক ঘটনা, অনেক মুহূর্ত হয়তো মিলে যাচ্ছিল অনেকের সাথে। আর যতই সেই শ্রোতারা নিজেদেরকে খুঁজে পেয়েছে শ্যামলের লেখায় ততই তারা অপেক্ষা করেছে, তার বইয়ের শেষ
কবিতার জন্য।

"কেমন আছো তুমি"- শ্যামল যখন আবৃত্তি শেষ করল, তখন তার নস্টালজিয়া, তার ভালোবাসা, তার ব্যর্থতা, তার অসম্পূর্ণ জীবিকা, তার ঘৃণা, তার সিগারেটের ধোঁয়া সব কিছু চোখের সামনে সজীব হয়ে উঠছিল। পায়ের তলার মাটির থেকে, আবির আরও বেশি অনুভব করছিল নিজেকে। তার লেখা তাকে ফিরে দিচ্ছিল তার অতীতে। নিয়নের আলো, সাংবাদিকদের ক্যামেরার ফ্ল্যাশ, হলরুমের গুঞ্জন সব যেন আবছা হয়ে যাচ্ছিল। তার আঙ্গুল কেঁপেছিল শেষ লাইনে এসে, এক আবেগঘন মুহূর্তে। 

চোখের জল চাপতে পারেনি, যখন দেখেছিল শেষ রো থেকে কান্না চেপে অর্পিতাকে বেড়িয়ে যেতে। ওড়নায় ঠোঁট ঢেকে বেড়িয়ে গেছিল রুম থেকে, মিলিয়ে গেছিল অসংখ্য মানুষের ভিড়ে। অবসন্ন ভাবে এলিয়ে দিয়েছিল নিজেকে শ্যামল; মূক বধিরের মতো সমস্ত ধেয়ে আসা প্রশ্ন উপেক্ষা করে শুধু লক্ষ্য করছিল তার ভালোবাসার মানুষটার অন্ধকারে মিলিয়ে যাবার দৃশ্য। অস্ফুটভাবে বলেছিল, "আমি ভালো নেই..."।

আজ শ্যামল হেরে গেছিল। কিন্তু অর্পিতাও জিততে পারেনি।

(ক্রমশ প্রকাশ্য, পড়তে থাকুন। পরবর্তী অংশ পরের প্রকাশনায়।)

ধন্যবাদান্তে,
সম্পাদক-নবপত্রিকা

No comments:

Post a Comment