স্বাধীনতার সুপ্রভাত। ব্যপারটা অবশ্যই বেশ উত্তেজক। পাড়ায় পাড়ায় ছোট ছেলেমেয়েদের ব্যস্ততা। যদিও সকাল থেকে আকাশের মুখ ভার (যেটা তথাকথিতভাবে একটা ছুটির দিন উপভোগ করার জন্য বেশ আদর্শ। যদিও যাদের শনিবার অফ-ডে থাকে, তাদের মুখ ভার করার যথেষ্ট কারন আছে। ভাবছেন, "এইতো সারা বছরে কয়েকটা মাত্র ছুটি পাই। তাতেও বড়বাবুর কথা শুনতে হয়, সুপারিশ করতে হয়। তার ওপর যদি ক্যালেন্ডার ও পঞ্জিকা-বাবুরাও এমন ছলনা করে, তাহলে আর কিছু বলার নেই। সবই অদৃষ্ট!"), তবুও দেখতে পেলাম ছাতা মাথায় বাবা-মায়ের হাত ধরে, অথবা বন্ধুদের সাথে আশা কচিকাঁচাদের ভিড়, স্কুল-গেটের সামনে। একটু নামী স্কুলের ক্ষেত্রে সেটা বেশ "সেলিব্রেশান" এর আকার ধারণ করলেও, "সর্ব শিক্ষা অভিযান"- এ সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলে সেটা শুধুমাত্র পতাকা উত্তলন, হেড-মাস্টারমশাই এর স্বাগত ভাষণ , ড্রিল ও অবশেষে সিঙ্গারা-জিলিপি এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। এমনকি পাড়ায় পাড়ায় উৎসাহ উদ্দীপনাও কিছু কম নয়। সকাল থেকে পাড়ার নেতা/ ছোট-মেজ-সেজ পদাধিকারীরাও রীতিমত পূর্ণ- উদ্বোধন ঘটিকা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন। রাস্তার মোড়ে মোড়ে (তীব্র মাইক) বন্দনা। "আহা! এই তো স্বাধীনতা!"।
শহীদ ও সংগ্রামীদের স্মরণসভা তো প্রতি বছর হয়। "আরে তাঁরা যা করে গেছেন আমাদের জন্য, তার জন্য আমরা চির ঋণী। ওটা নিয়ে নতুন কিছু ভাবার নেই। তবে গতবারের থেকে এবারের দিন ( আসলে ছুটি)-টা একটু আলাদা ভাবে উদযাপন করতে হবে।" একটু নতুন কিছু শপিং চাই, প্রি- পুজো সেলে মহার্ঘ্য ছাড় চাই, ই-কমার্স সাইটে লোভনীয় কাশব্যাক চাই, সকাল সকাল বাজারে গিয়ে গিন্নির জন্য সাধের "ইলিশ" চাই, অথবা দুপুরে চুটিয়ে ভুঁড়িভোজ চাই বাড়িতে অথবা নামী রেস্তরাঁ -তে। এই যা! "ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট" তো ভুলেই গেলাম! সঙ্গীত জলসা- উষ্ণ পরিবেশের সাথে কোনও পানশালায় রাতভোর নাচাগানা চাই। "বেশ একটা মোচ্ছবের অনুভব আসছে তাই না?" ও! মন্ত্রীদের (যাদের আমরা সারা বছর নানা কারণে মুণ্ডপাত করি) সুমিষ্ট "একতা- ঐক্য- ধর্ম নিরপেক্ষতা- সম্প্রীতি" এর ভাষণ তহ ভুলেই গেলাম। সরকারি টিভি চ্যানেল টা নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও, বেসরকারি চ্যানেল ওসবের ধার দিয়েও যায়না। আরে! দাদা! ব্লকবাস্টার ছবিগুলো তো আজকেই সিডিউল্ড।
আপনি এতক্ষণে আমার "শ্লেষ" আঁচ করে ভাবছেন, "সক্কালবেলা আদা-জল খেয়ে নিতান্তই এক বেরসিক মানুষ স্বাধীনতার মাহাত্ম্য নিয়ে বিচার করতে বসেছে। যত সব "ওল্ড" চিন্তাভাবনা। অত ভেবে লাভ কি বাপু? কিছু তো পরিবর্তন হবে না! কেউ কি যেচে ক্ষুদিরাম হতে চায়? যা হছে চলুক। গড্ডালিকা প্রবাহ তো! চললেই হল। কোথাও না কোথাও ঠিক পৌঁছে যাব।" আমার শুধু একটাই প্রশ্ন, "ওই ঋণের ব্যপারাটা ভেবেছেন?" চোখ কপালে তুলে ভাবছেন "কোন ঋণ? কিসের ঋণ?"
"স্বাধীনতার ঋণ"। আপনিও করেছেন, আমিও করেছি। আমাদের আগামী প্রজন্মও করবে। কিন্তু একবারও সেটা ফিরিয়ে দেবার কথা ভেবেছেন? পরিশোধ করার একটা চেষ্টা? ভাবছেন "কোন উপায়ে তা সম্ভব?" উত্তরটা সরাসরি দেওয়া আমার ধৃষ্টতা হবে। তবে অবশ্যই একটু অন্য ভাবে বলতে পারি। বলতে পারি আমার চোখে স্বাধীনতার মানেটা ঠিক কি।
স্বাধীনতা মানে, আমার কাছে "যা- ইচ্ছে" করার অধিকার নয়। বরং আমার মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকারের সবটুকু পাবার ইচ্ছা। অবশ্যই এই দিন উৎসবের, প্রেরণার তবে তা কখনই "বার্ষিক স্মরণ সভা" নয় (রোজ তো দেশের কথা ভুলে যাই, তাই একদিন ধার্য হল সবাই মিলে স্মরণ করার জন্য)। আমার কাছে স্বাধীনতা মানে, যেদিন আমার গাড়ি জ্যামে দাঁড়িয়ে গেলে ওই মেয়েটা কোলে একটা আধপেটা শিশু নিয়ে জানালার কাঁচের কাছে এসে দাঁড়াবে না; যেদিন চায়ের দোকানে বিতর্কের বিষয় "আমরা কি পারিনি?" থেকে হবে "আমরা কি কি করতে পারি?"; যেদিন সকালের প্রথম পিরিয়ড- এ থাকবে না ভূগোল আর ইতিহাস, শুধু থাকবে "মানুষ হবার শিক্ষা"; যেদিন প্রত্যন্ত গ্রামের কোনও এক ঘরে সন্ধ্যাবেলা জ্বলে উঠবে আলো, ওরা পড়তে বসবে; যেদিন শিক্ষার্থীকে আকৃষ্ট করতে "শিক্ষা অভিযানের" মাধ্যমে "খাবারের টোপ" দিতে হবে না; যেদিন কাঁটাতারে গাঁথা হবে ফুল; যেদিন সংবাদ-মাধ্যম "দলীয় প্রচারের" অস্ত্র হবে না; যেদিন কোপাইয়ের চরে পাওয়া যাবে না আরেকটা কোনও কন্যা- সন্তানের দেহ; যেদিন মানুষ "নিজের" বাঁচার থেকেও "অন্যের বাঁচার" জন্য আরও বেশি করে লড়বে; যেদিন বদ্ধ ঘরে সেই মেয়েটা হাতের মুঠোয় ব্লেড ধরে নিজেকে শেষ করে ফেলার কথা ভাববে না; যেদিন প্রতিবাদী কবিতার লাইনকে বলা হবে না "রাষ্ট্রদ্রোহিতার হাতিয়ার"; যেদিন বরুন বিশ্বাসরা আবার ফিরে আসবে আমাদের মাঝে অন্য রূপে।
যেদিন, আমাকে আমার ব্যক্তি- স্বাধীনতা নিয়ে আর ভাবতে হবে না।
ভাবছেন, এসব কি আদৌ সম্ভব? তাহলে বলি ওই ঋণের কথার প্রসঙ্গ তুলে আবার বলি, "চেষ্টা করতে ক্ষতি কি?"
ধন্যবাদান্তে,
সম্পাদক-নবপত্রিকা
সম্পাদক-নবপত্রিকা
No comments:
Post a Comment