Code

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

Second Header

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

Saturday, September 5, 2015

কেমন আছো তুমি - তৃতীয় পর্ব

এবার এই আড্ডাটাকে আরেকটু এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাক। আজ বলব, কিছু অন্য অনুভূতির কথা। এমন কিছু মুহূর্তের কথা, যার রেশ থাকবে আপনার মনে; আপনাকে ভালো থাকার মানে বুঝতে সাহায্য করবে। জানতে চান, কেমন ভাবে সেই মুহূর্তগুলো হাতের মুঠোয় ধরবেন? সত্যি বলতে সময় চোরাবালির মত, যত ধরতে যাবে, ততই সে পিছলে যাবে বন্ধনের বাইরে। রয়ে যাবে, এই সব "মুহূর্তগুলো"।

আসুন একজনের সাথে পরিচয় করাই। আবির। আপনাদেরই মধ্যে থেকে বেছে নেওয়া একটা মুখ, যে বেরিয়ে আসতে চায় তার শহর-ক্লান্ত জীবনের বেষ্টনী থেকে। সকাল সাড়ে ন'টার ভিড়ে ঠাসা মেট্রো, তিলধারণের জায়গা পর্যন্ত নেই। গড়িয়া থেকে শ্যামবাজার, এটাই নিত্যদিনের যাতায়াতের পথ। মানুষের নিঃশ্বাস বাড়িয়ে দেয় উত্তাপ, শরীর গলতে থাকে ঘাম হয়ে; তিলেতিলে ভিজে যায় জামা। কিন্তু তখন হয়ত আবির ব্যস্ত গতরাতের অসমাপ্ত কাজের খতিয়ান নিয়ে। "কি বাকি, কি করতে হবে" এই অঙ্কের মাঝে যখন তার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে, মেট্রো তখন পেরিয়ে যাচ্ছে একের পর এক ষ্টেশন...টালিগঞ্জ, রবীন্দ্র সদন, মহাত্মা গান্ধী রোড। চারপাশের মানুষের ওঠা নামার ব্যস্ততা, মোবাইল ফোনে ফ্ল্যাটের দাম আর ব্রেক-আপের কথা, ট্রেনের যান্ত্রিক শব্দ সব কিছু যেন ফিকে হয়ে যায়, আরেক যন্ত্রের কাছে- আবিরের মন। সে নিজেও জানেনা এভাবে কতগুলো বছর কেটে গেল।

কলেজ ষ্ট্রীটকে আবির খুব মিস করে। প্রেসিডেন্সিতে পড়ার সময় ছাত্র আন্দোলন, পুলিসের লাঠি, অনশন, বাড়ির তিরস্কার, আর বই পাড়ায় অজস্র ভিড়ের মাঝে প্রথম প্রেম - অনেক কিছুই ছিল একটা সময়। জীবনানন্দ, পূর্ণেন্দু পত্রী, শঙ্খ ঘোষ, জসিমুদ্দিন আবার কখনও নিজের লেখা- তার অশান্ত জীবনে এরাই ছিল সঙ্গী। জীবন অশান্ত ছিল, কিন্তু তাতে ছিল তরঙ্গ। ভালো,মন্দ,ক্ষতি,ভয়,ঘেন্না,আক্ষেপ - সব ছিল। আবির তখনও "আবির" ছিল।

কিন্তু শেষ কয়েকটা বছরে পায়ের বেড়ি যেন আরও শক্ত হয়ে এসেছে। সংসার সামলানোর দায়িত্ব তার কাঁধে। নাহ! আবির নিজেও চায়নি বেদুয়িনের মত ঘুরে বেড়াতে আর মাঝবয়সে এসে "সমাজের অবোধ্য নিয়ম নীতি"-র ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দায় সারতে। সাদামাটা পরিবারটাকে একটু সচ্ছল করে তুলতে চেয়েছে সে। কিন্তু ক্রমে ক্রমে সে নিজেও যেন ক্ষয়ে গেছে। সেলসের টার্গেট, ক্লায়েন্ট, মিটিং, রেট, পাই চার্ট, গ্রাফ এসবের মাঝে গলার টাই আলগা করার সুযোগ পায়নি সে।

তবে একটা দিন এল। তারিখতা ঠিক মনে নেই। আসলে এমন দিনেরা মনের অজান্তেই আসে, আবার স্মৃতির আড়ালে লুকিয়ে যায়। বাগবাজার বাটার সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে। প্রায় সক্কালবেলা অফিস টাইমে মুষলধারে বৃষ্টি। দোকানের ছাউনিতে পা রাখার জায়গা পর্যন্ত নেই। ঘড়ি,মোবাইল, দামি জুতো, জামার প্রায় অর্ধেক- অনেকটাই কাকভেজা অবস্থা। এখান থেকে এখনও মিনিট কুড়ি হেঁটে যেতে হবে। কিন্তু বৃষ্টি এতটাই প্রবল যে, ছাতায় মানবেই না। পাশে দাঁড়িয়ে আরও কয়েকজন পথচারী। নিতান্তই বিরক্ত এই অকাল বর্ষণে। "ধুর মশাই, এই আবহাওয়া দপ্তরের লোকগুলো যে কেন মাইনে পায় কে জানে! কাল রাতের খবরেও তো কিছু বলল না।"। আরেকজন বয়স্ক ব্যক্তির উগ্র মন্তব্য "মশাই! বুঝলেন না? নিম্নচাপ! ও বলে কয়ে আসে না!"

কেউ অভিশাপ, কেউ বিরক্তি, অথবা কেউ যখন আক্ষেপের ঝুলি নিয়ে ব্যস্ত, আবির অনেকটাই আনমনা তখন। মোবাইলের ঘন ঘন রিং হয়ে চলেছে। পাশ থেকে একজন বললেন "দাদা! আপনার মোবাইলে কল আসছে।" আবির হেসে বলল, "জানি..."। সে ব্যক্তি একটু আশ্চর্য হয়ে সরে গেলেন, আরেকটু নিরাপদ ছাউনির দিকে। তখন বাজে প্রায় সকাল এগারোটা। মনে হবে না সেটা ব্যস্ত কলকাতার পাঁচ মাথার মোড়। গাড়ি, মানুষ, জল, কাদা - আর বৃষ্টির সমারোহ। "আজ ক্লায়েন্টের সাথে মিটিং ছিল। কিন্তু আর হল না মনে হচ্ছে। অর্পিতাও বারবার ফোন করছিল অফিস থেকে, মনে হচ্ছে, আজকের অনুপস্থিতিটা বস ঠিকভাবে নেয়নি। কিন্তু আদৌ কি সেটা আমার হাতে? এতোগুলো বছর পরেও কেউ যদি আমার ইচ্ছা- নিষ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করে, তাহলে সে চাকরি না থাকাই ভালো"- আবির মনে মনে ভাবছিল। আর সে জন্যই হয়ত ফোনে কৈফিয়ত দেবার চেয়ে আনমনে বৃষ্টি দেখা তার অনেক বেশি ভালো মনে হল। হয়ত নস্টালজিক অনুভব করল।

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক ভদ্রমহিলাকে বিনয়ের সুরে বলল, "এক্সকিউস মি! আপনি প্লিজ আমার ব্যাগটা ধরবেন?"। সদ্য আঠাশ পেরনো যুবতী কিছুটা আড়ষ্টভাবে ভাবে ব্যাগটা নিলেন, কিন্তু "কারণ" নিয়ে জিজ্ঞেস করার আগেই আবির ছাউনি থেকে বেরিয়ে এল। আঙ্গুলের অল্প টানে খুলে ফেলল টাই। মুশলধারে যখন বৃষ্টি তার জামা, তার শরীর, তার মন ভিজিয়ে দিচ্ছিল আবির একবার ফিরে তাকাল ছাউনির দিকে। সেই যুবতী তখনও অনেকটা হতভম্ব 'কি রে বাবা! লোকটার মাথা খারাপ নাকি? এর মাঝে ব্যাগটাও ধরিয়ে দিয়ে গেল। এখন কি করি?" আবির মনে মনে শুধু একটা কথাই বলল "আর ফিরব না"।

বৃষ্টি তখন স্রোতস্বিনী হয়ে ধুয়ে দিচ্ছে এতদিনের তিলতিল করে জমতে থাকা ক্লান্তির ঘাম। বার বার তার আঙ্গুল কপাল থেকে আঁচড়ে নিচ্ছে চুল। ভিজে যাচ্ছে সব কিছু। মন-প্রান-জীবন। গাড়ির হর্ন, জ্যামের চিৎকার, বাজারের গুঞ্জন, মেট্রোর ভিড়, অফিসের তাড়া, টার্গেটের পাই চার্ট সব কিছু যেন গলে জল হয়ে যাচ্ছিল। আবির যখন বৃষ্টিতে অঝোরে ভিজছে, সেই যুবতীও হয়ত এমন এক মুহূর্তের জন্য আক্ষেপ করছে। সে পারেনি, আবির পেরেছে। আবির নিজেও জানেনা এভাবে কতক্ষণ দুহাত দুপাশে বাড়িয়ে, চেয়ে থেকেছে মেঘলা আকাশের দিকে; জানেনা কতবার সে কেঁদেছে অজানা আবেগে-নিজের অপ্রাপ্তিগুলোর কথা ভেবে; জানেনা কিভাবে বৃষ্টি লুকিয়ে দিয়েছে তার চোখের জল।

খানিক বাদে, হেঁটে ফিরে এল ছাউনিতে, বলল, "ধন্যবাদ"।

(ক্রমশ প্রকাশ্য, পড়তে থাকুন। পরবর্তী অংশ পরের প্রকাশনায়।)

ধন্যবাদান্তে,
সম্পাদক-নবপত্রিকা

1 comment:

  1. বাঃ, ভাল লাগল। এই ছোট ছোট ভাললাগাগুলোই তো আমাদের মুক্তির স্বাদ এনে দেয় জীবনে... :-)

    ReplyDelete