Code

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

Second Header

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

Monday, December 28, 2015

"সাহসিনী"


সাহসিনী-বিশেষ প্রতিবেদন
২৯শে ডিসেম্বর নবপত্রিকার বিশেষ প্রতিবেদন- "সাহসিনী"
Posted by Life: Unplugged on Friday, December 25, 2015

২৯শে ডিসেম্বর, ২০১২ মধ্যরাত ২:১৫, যখন সারা দেশ জেগে রয়েছে আকুল প্রার্থনা নিয়ে, মেয়েটা তখন আজীবনের জন্য ঘুমের কোলে ঢলে পড়ল। শেষ হয়ে গেল ১৫ দিনের আপ্রাণ লড়াই। আমরা, আমাদের সমাজ, আমাদের দেশ- সব্বাই হেরে গেলাম। ভারতীয় মিডিয়ার সৌজন্যে তার প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসের খবর এসে পৌঁছেছে ড্রয়িং রুমে, সোশ্যাল সাইটে, পাড়ার ক্লাবে, সুদূর গ্রামের একমাত্র রেডিও ষ্টেশনে। কখনও মেয়ে, কখনও বোন, কখনও নেহাত আপনজন ভেবে উদ্বিগ্ন হয়েছে সহস্র চোখ। পরদিন সকালের ব্রেকিং নিউজে খবরটা ছড়াতেই কোথাও কেউ হাপুস নয়নে কেঁদে ভাসিয়েছে এইভেবে "মেয়েটা চলে গেল!", কোথাও রক্তিম চোখে ক্ষোভ ফেটে পড়েছে শহর থেকে শহরে, স্তব্ধ হয়ে গেছে রাইসিনা হিলস। যখন কোলকাতার "সাইলেন্ট মার্চে" মোমবাতির "ওম" ছুঁয়ে গেছে অসংখ্য হৃদয়, তখন দিল্লি গর্জে উঠেছে টিয়ার গ্যাস আর জল- কামানের আঘাতে। বেঙ্গালুরু থেকে বস্টন- প্রতিবাদ, আলোচনা, বিতর্ক কিছুই বাদ যায়নি। কিন্তু প্রশ্নটা তো রয়েই গেছে? ভারতীয় সমাজ এখনও কি "নারীদের বাসযোগ্য" হতে পেরেছে? এখনও কি সাবালক হতে পেরেছে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র?



আচ্ছা দোষীদের সাজা পাওয়াটাই কি আসল সাফল্য? লোকসভা রাজ্যসভাতে ঘন ঘন আলোচনার পর নারীর স্বার্থ রক্ষার্থে তৈরি হওয়া তথাকথিত আইন ও বিলই কি যথেষ্ট? ফাস্ট-ট্র্যাক কোর্ট, নতুন হেল্পলাইন নাম্বার এইগুলোই-আমাদের কৃতিত্ব "সাহসিনীর" মৃত্যুর পর? নাকি ধর্ষণের মত একটি গুরুতর বিষয়কে আখেরে ভারতীয় সমাজের "আনুসাঙ্গিক ব্যাধি" হিসাবেই ধরে নিয়ে তার শুধু "উপশমের" ব্যবস্থা করা হল? মেনে নেওয়া হল এই যে "যা চলছিল তা চলবে, কিন্তু দোষীরা আগের তুলনায় আর বেশি সাজা পাবে"। হায় রে আইনের কারিগর! শাস্তির কোপের ভয়েই যদি সবাই "ঘৃণ্য অপরাধ" থেকে বিরত থাকত, তাহলে কি "নির্ভয়া"কে এভাবে চলে যেতে হত?

তাহলে ভাবছ, কিছুই হয়নি? শুধুই......না! একেবারেই নয়। অবশ্যই পরিস্থিতি বদলেছে, এই দেশ যেমন প্রতিবাদের নতুন ভাষা পেয়েছে, তেমনি একই হারে বাড়তে থাকা অপরাধের প্রতি আইনি ব্যবস্থার উদাসীনতাও বেড়েছে; সামনে এসেছে "সাজানো ঘটনার তত্ত্ব"। (সু)শাসনের নামে আর বেশি করে অপরাধকে ঢাকা দেবার পন্থা রপ্ত করা হয়েছে।

অনেকে বলে ভারতীয় সমাজ "পুরুষশাসিত"। অনেক নিন্দুকেরা আবার তর্কের সুরে বলেন, "আরে দাদা, অফিস টাইমে ভিড় বাসের লেডিস সিট, নারী কর্মসংস্থান প্রকল্প, পাড়ায় পাড়ায় মহিলা সমিতি- এসব কি মুখ দেখতে? সত্যিই পুরুষশাসিত হলে এইসব হত?" আমার মতে "আমরা একটি সামাজিকভাবে অপরিণত দেশ"। বিশ্বায়নের সুযোগে পাশ্চাত্যের আধুনিক,আকর্ষণীয় এবং তুলনামূলকভাবে অনেকটাই খোলামেলা জীবনযাপনের "কনসেপ্ট" যখন একটি কৃষি নির্ভর "হাল চালাই, খেটে খাই" সমাজে ঢুকে পড়ল, তখন আমাদের সামাজিক চিন্তাভাবনার স্তরগুলোর মধ্যে ফারাকটাও আরও প্রকট হয়ে উঠল। অনেকে এটা প্রাচ্য বনাম পাশ্চাত্যের সংঘর্ষ বলতে পারেন, কিন্তু সত্যি বলতে আমি এই তর্কে যেতে চাইনা। কখনই বলতে চাইনা পাশ্চাত্যের স্বাধীনচেতা মনোভাব আমাদের পক্ষে খারাপ। বরং এটা ভাবা উচিত, আমরা কতটা তৈরি ছিলাম সেই ধারণাগুলোর সাথে খাপ খাইয়ে নিতে। একটা স্তরের মানুষ যখন বিলাস-ব্যসনে, পোশাক-আসাকে আধুনিক জীবন যাপনের জন্য ব্যকুল, তখন এটাও বোঝা দরকার আমাদের দেশের কোটি কোটি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নীচে বাস করে। কিন্তু এর সাথে ধর্ষণ বা নারী নির্যাতনের মত জঘন্য অপরাধের সম্পর্ক কোথায়? ওই যে! ঠিক যে কারণে আপনার স্বাধীনচেতা নারীসত্তাকে, বাসে-ট্রামে-অফিসে-রাস্তায়, ট্যাক্সির পিছনের সিটে, বেশি রাতের একলা রাস্তায় প্রতিমুহূর্তে সহস্র কামুক পুরুষ দৃষ্টি এড়িয়ে এগিয়ে যেতে হয়। সমাজের একটা অংশ নারীদের শিক্ষা ও মানসিকতা প্রসঙ্গে এগিয়ে গেলেও, এখনও আরেকটা বিরাট অংশ তাদের "শারীরিক তৃপ্তির" অংশ বলেই মনে করে। সমস্যাটা ঠিক এই খানেই। মেয়েদের খোলামেলা ভাবনাচিন্তাকে যখন সমাজের একটা অংশ স্বাধীনতার পরিচয় হিসাবে সম্মান করে, তখন ঠিক আরেকটা অংশ সেটাকে "যৌনতা অথবা উশৃঙ্খলতা" হিসাবে ভাবে। তাহলে সেই প্রশ্নটা আবার ঘুরে ফিরে এল, আমরা কি তৈরি নারীদের জন্য একটা সভ্য নিরাপদ বাসযোগ্য সমাজ দেবার জন্য? নাকি পুরুষের আদিম আকাঙ্ক্ষার কোপে পড়ে,এভাবেই একের পর এক নির্ভয়াকে ঘৃণ্য অপরাধের যূপকাষ্ঠে বলি দিয়ে যেতে হবে?

কিন্তু যে সমাজে, একটা সময় "নারীর" অপরিসীম গুরুত্ব ছিল, সেখানে এই ধরণের অবনমন কেন? ভারতের মত একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশে কম বেশি সমস্ত ধর্মেই নারীকে মাতৃরূপে (সৃষ্টির আদি উৎস) হিসাবে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ধর্মীয় অনুশাসন কোথাও হয়েছে পায়ের বেড়ি, কোথাও বা শুধু গ্রন্থের পাতাতেই সীমাবদ্ধথেকেছে। নারীকে "ভোগ্যপণ্যে" রূপান্তরিত করার কারণ খুঁজে পাওয়া যায় একটা মেয়ের এই সজীব পৃথিবীতে বেড়ে ওঠার প্রত্যেক গল্পে। "ছেলে না হওয়ায়" পরিবারের আক্ষেপ, একই পরিবারে অন্য সন্তানের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বঞ্চনা, নারী শিক্ষায় আমাদের সরকারের "ধীরে চলো নীতি" (বিশেষত গ্রামীণ শিক্ষা ব্যবস্থায়), কৈশোর থেকেই মেয়েকে শিক্ষার আলো দেবার বদলে ঘরকন্নার কাজে ঠেলে দেওয়া, যৌবনের চৌকাঠ পেরতেই তাকে "দায়" হিসাবে নিজের কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলার অদম্য চেষ্টা, বিবাহ পরবর্তী জীবনে সামান্য সম্মানের জন্য নিরন্তর লড়াই করা, এমনকি এই অধিকারের সংগ্রামে পিষতে পিষতে শেষ হয়ে যাওয়া- এই সবই তো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় কেন নারীরা আমাদের সমাজে বঞ্চিত। একটা নারীর সমস্ত অধিকারকে তিলে তিলে কেড়ে নেওয়া তো এক প্রকার ধর্ষণ! একটা সাধারণ মেয়ের নিজের সামাজিক পরিধির মধ্যে বেড়ে ওঠার পথেই যদি এত প্রতিকূলতা থাকে, তাহলে বাইরের অবস্থাটা আর খারাপ হতে বাধ্য। আর সেই ছেলেটা? যে সারাটা সময় তার আশেপাশে এমন অসংখ্য মেয়ের বেড়ে ওঠা দেখেছে, তার মানসিক আকৃতিটা কেমন হবে? পরোক্ষভাবে সেও তো একটা মেয়েকে "নিজের অধিকার" হিসাবে ভাববে! তাহলে আমরা আমাদের নিজেদের মধ্যেই অপরাধী আর নিপীড়িতদের বাড়িয়ে তুলছি না?

মেয়েদের আব্রু-সম্ভ্রম এগুলো অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিষয়। আর সেটা রক্ষা করার দায়িত্ব প্রত্যেক পুরুষের। সমস্যাটা একটা মেয়ের বেশভূষা নিয়ে নয়, সমস্যা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির- সেই মেয়েটিকে আমরা কিভাবে দেখি। তার মধ্যে আমরা কি আমাদের মা- আমাদের বোন- নাম না জানা বন্ধু- জীবনসাথী স্ত্রী খুঁজে পাই? নাকি খুঁজে পাই একটা ভোগ্যপণ্য? এই প্রশ্নটাই আজ আমাদের করা উচিত। খবরের মাঝখানে "উত্তেজক তেলের" বিজ্ঞাপন, টিভি- সোশ্যাল মিডিয়াতে বিজ্ঞাপন হোক বা বিনোদন
(সামান্য মুখে মাখার ক্রিম থেকে অন্তর্বাস; প্রতিটি ক্ষেত্রে মূল বিষয় হয়ে দাঁড়ায় কি করে সেই পণ্যের ব্যবহারে একটি ছেলে অসংখ্য মেয়ের সান্নিধ্য পাবে)- নারী শরীরকে একটি "সহজলভ্য পণ্য" হিসাবেই উপস্থাপনা করা হয়ে থাকে- যা নিঃসন্দেহে অন্যতম একটি কারণ পুরুষদের পাশবিক প্রবৃত্তির জন্য। তাই বলে মেয়েদের চলে যেতে হবে অবগুণ্ঠনের অন্তরালে? পর্দা প্রথা? কখনই নয়! বরং আধা-শিক্ষিত সমাজের মানসিকতা যেসব "ফ্যাক্টর" গুলো নিয়ন্ত্রণ করে, তাদের আরেকটু সচেতন
হতে হবে। একটা মানুষ (যার মান আর হুঁশ দুটোই থাকে) তার মানবিক পরিস্থিতি থেকে পাশবিক হয়ে ওঠার পেছনে এই কারণগুলো অনেকাংশে দায়ী।

কিন্তু অনেক অপরাধের ক্ষেত্রেই, শিক্ষিত যুবকদের সংযোগও লক্ষ্য করা গেছে? এরপরও কি বলা যায়, শুধুই অশিক্ষা আর দারিদ্র্য, সামাজিক বঞ্চনা, হতাশা, লোভ এগুলোই নারী সংক্রান্ত অপরাধের মূল কারণ? সমস্যার আরেকটা উৎস হল আমাদের অশালীন মানসিকতা। ভারতীয় সমাজে, "যৌনতা" আজও একটি সংবেদনশীল বিষয়, এবং সেটি নিয়ে গোপনীয়তা ও ছুঁৎমার্গের অন্ত নেই। আজও স্বল্প বসনা লাস্যময়ী নারীত্বকে ঘরের বেডরুম আর ল্যাপটপের পর্দায় বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়, কিন্তু বাইরে সেইটাকেই অশালীনতার নাম দিয়ে ঢাক পেটানো হয়। সালোয়ার কামিজের জন্য শিক্ষিকাকে স্কুল ছাড়তে বাধ্য করা হয়, কিন্তু টিভির পর্দায় অভিনেত্রীর লাস্যতা দেখার জন্য সবাই মুখিয়ে থাকে। আর এই গোপনীয়তা, এই দ্বিমুখীতা, এই মুখোশের আড়ালে নারীকে দিনে দিনে যৌন আবেদনের বস্তুতে পরিণত করার জন্য আমাদের "আদিম" ধ্যানধারণাই দায়ী। পণ প্রথা, বাল্য বিবাহ, বিবাহ সম্পর্কে জাতপাতের ভেদাভেদ এরই ফলাফল। আমাদের মনে রাখা উচিত, ইচ্ছার বিরুদ্ধে একটা
মেয়েকে বিবাহের নামে, একটা ভিন্ন পুরুষের সাথে সহবাস করতে বাধ্য করাও এক প্রকার "ধর্ষণ"; আর এই সংখ্যাটাও নেহাত কম নয়।অপরাধীর আর অপরাধ প্রবণ মানুষের মধ্যে ফারাকটা খুব কম। তারা মিশে থাকে আমাদের মধ্যেই। এমনকি হয়ত আপনি নিজেও জানেননা সারাদিনে পথ চলতে বিভিন্ন সময়ে আপনি নিজেও কোনও না কোনও ভাবে এই বৈষম্যের প্রকাশ করেছেন কোনও মেয়ের প্রতি। একটু ভাবুন! আরেকবার ভাবুন।

ভিড় বাসে অফিস টাইমে লেডিস সিট ছেড়ে দিতে হলে যদি আপনার মনে কোন বিরক্তি আসে, তাহলে মনে রাখবেন, আপনি একজন লিঙ্গ বৈষম্যকারী ব্যক্তি। আর ধর্ষণের মত কুরুচিকর ঘটনা এরই বৃহত্তর প্রকাশ। ভাবতে অবাক লাগছে তাই না? নির্ভয়ার মৃত্যুর পর নারী নির্যাতনের সংখ্যায় কোন পরিবর্তন আসেনি, বরং খবরের কাগজ আর মিডিয়ার বুলেটিনে ব্রেকিং নিউজ থেকে তা "স্পিড নিউজে" স্থানান্তরিত হয়েছে। তাহলে পরিবর্তনটা এল কই? সেটাও কি সত্যিই আসা সম্ভব? কিছু
সমাজকর্মীর সাথে আলাপচারিতার সৌজন্যে যেটুকু জানি, "এই পরিবর্তন সম্ভব, তবে সময় লাগবে।" হ্যাঁ, সময় লাগবেই!

আমরা নিজেরা পারি না একটু সচেতন হতে? লিঙ্গ বৈষম্য ও সেই সংক্রান্ত অজস্র নির্যাতনের বিরুদ্ধে সারা বিশ্ব যখন সরব, তখন আমরা পারিনা সেই আন্দোলনে সামিল হতে? শুধু ধর্না, মিছিল, মোমবাতির নীরবতা নয়- পরিবর্তনটা আমরাই নিয়ে আসি না? আর সেই পরিবর্তনটা কিভাবে আসবে? প্রতিবাদ করুন, গর্জে উঠুন, একজন শেষ হয়ে গেলে, আরেকজন উঠে দাঁড়ান। নিজের আশেপাশে কোনও ঘটনা চোখে পড়লে রুখে দাঁড়ান। সামাজিক লজ্জায় গুটিয়ে যাওয়া নয়, বরং মুখ ফুটে বলুন কষ্টের কথা। অপরাধের ভয়ে কুঁকড়ে গেলে হবে না, লোকলজ্জার অভিমানে অন্ধকারে আশ্রয় নিলে হবে না। প্রশাসন হোক বা সমাজ, সকলের চোখ রাঙানই উপেক্ষা করে অভিযোগ জানাতে হবে। মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে বার্তা, যাতে সকলে পাশে এসে দাঁড়াতে পারে। এই ঘৃণ্যতার কোনও ক্ষমা হয়না, এই ক্ষতি অপূরণীয়- কিন্তু দোষীদের সাজার জন্য দৃঢ়ভাবে "সাহসিনী" হতে হবে। একজন না শুনলে, আরেকজনের কাছে পৌঁছে যেতে হবে। সাহস রাখতে হবে, এখনও কিছু ভাল মানুষ আছে এই পৃথিবীতে। আমাদের আগামী প্রজন্মকে, নিজের সন্তানকে সচেতন করুন মেয়েদের অধিকার আর সম্মান সম্পর্কে- যাতে ভবিষ্যতে তার মধ্যে কোনও পশু না বাসা বাধে। জৈবিক ভাবে প্রত্যেক পুরুষই কোনও না কোনও নারী জঠরে লালিত হয়েছে জন্মের আগের মুহূর্তে। সৃষ্টির আদি শক্তিই হল নারী। মাতা মেরী থেকে মা দুর্গা, আগলে রেখেছে তার সন্তানদের। একজন নারীই পারে একটা সুস্থ জাতির জননী হতে। একটা মেয়েই পারে অসংখ্য রূপে আমাদের ঘিরে থাকতে, কখনও স্নেহ-মমতায় কখনও ভালবাসায়; অজস্র প্রতিকূলতার আগুনে পুড়েও "সাহসিনী" হয়ে উঠতে।

আর আগামীকে সুনিশ্চিত করতে ঠিক কি কি করা দরকার? কি করলে এই সমাজ নারীদের বাসযোগ্য হবে? "বৈষম্য" সরাতে হবে-সেটা যে ধরনেরই হোক, জীবনের যে পর্যায়েই হোক। প্রকৃত শিক্ষা ও সাহায্য পৌঁছে দিতে হবে প্রত্যেক ঘরে, প্রাধান্য দিতে হবে গ্রাম্য পরিবেশে বেড়ে ওঠা মেয়েদের, কর্মক্ষেত্রে সমান সুযোগ আনতে হবে মেয়েদের জন্য, শুধু তাই নয়- কর্মক্ষেত্রে ঘটা যেকোনো অসহিষ্ণুতাকে কড়া হাতে দমন করতে হবে, প্রশাসনকে আরও ভরসাযোগ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে, মেয়েদের সম্মান প্রসঙ্গে সচেতনতা বাড়াতে শিক্ষাকে মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করতে হবে (নব্য প্রজন্মের চারিত্রিক গঠনের প্রতি আমাদের আরও বেশি সজাগ হতে হবে), জীবনের যেকোনো মুহূর্তে তাদের স্বাধীন চিন্তা-ভাবনা ও সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার দিতে হবে, "পিছিয়ে থাকার" তকমা ঘোচাতে হবে নারীমন থেকে, "অবলা নয়, সবলা হয়ে ওঠাই লক্ষ্য হতে হবে", যে সমস্ত গণ মাধ্যম বৃহত্তর জনমানসে প্রভাব বিস্তার করে তাদের আরও সচেতন হতে হবে কোনও নারী চরিত্র/ শরীরকে পণ্য/ উপস্থাপনার সাথে ব্যবহার করার আগে। অপরাধের শাস্তির চেয়েও অপরাধ রোখার প্রচেষ্টা বাড়াতে হবে। মেয়েদের সঙ্গে হতে থাকা প্রতিদিনের ছোট ছোট বঞ্চনার বিরুদ্ধে তাদের সরব হতে হবে।

"আমি স্বপ্ন দেখি সেই সূর্যের" যেদিন দূর কোনও গ্রামের আলো আঁধারই ঘরের ছায়ায় কোনও বাবার কোলে আধ ঘুমে আছন্ন মেয়ের কানে ভেসে আসবে মাটিয়ালি সুর, যেদিন কোপাইয়ের জলে ভেসে আসবে না আর নতুন কোনও নাম, যেদিন ট্র্যাফিক সিগনালে অল্পের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির মাঝে আর ঘুরবে না বাচ্চাকোলে কোনও পথভোলা মেয়ে, যেদিন ঘরের মেয়ে হবে না কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার বোঝা, যেদিন শাস্তির কঠোরতার চেয়ে সম্ভ্রম আর সচেতনতার দিকে আরও নজর দেবে মানুষ,
যেদিন একা রাতে সে বাড়ি ফিরবে "নির্ভয়ে"।

শেষ করার আগে, "সাহসিনী ও তার মৃত্যু পরবর্তী সময়ে আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি" নিম্নোক্ত কবিতাটি উদ্ধৃত করা হল। এই লেখাটি প্রতিবিম্ব পত্রিকায় ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। পত্রিকা ও কবির অনুমতি নিয়ে লেখাটির সামান্য পরিবর্তন করে আজকের দিনটিকে মনে রেখে এখানে পুনঃপ্রকাশিত করা হল। দামিনীর অন্যতম হত্যাকারী আজ মুক্ত। সমাজ তাকে আবার বাঁচার সুযোগ দিলেও আইনী দুর্বলতা আরও তার মতো অপরাধীর জন্ম দেবে কিনা তর্কসাপেক্ষ।

ঊনত্রিশে ডিসেম্বর
শুভজিৎ সাহা, কোলকাতা
সম্পাদক- প্রতিবিম্ব পত্রিকা

আজ ঊনত্রিশে ডিসেম্বর দামিনী।
এই ক'বছরে আরও কত কত বার
তুমি খবরের হেডলাইন।
বদলায় স্থান-কাল, তুমি মরো প্রতিবার।

দামিনী, আমরা মোমবাতি মিছিল করেছি।
রং-বেরঙ-এর মোমবাতি চার্চের সামনে,
সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং-এর যুগে
ছবির গুরুত্ব অপরিসীম।
ছবি তুলেছি তাই অনেক দামিনী।
ব্লগ লিখেছি, তর্ক করেছি, প্রশাসনের
বাপ-মা এক করেছি।
তুমি মৃত্যুশয্যায় দোষীদের শাস্তি
চেয়েছিলে দামিনী।
আমরা তাদের লালন করেছি সযত্নে,

আমাদের যত রাগ শুধু ক্যামেরার সামনে,
কবিতার খাতায়।
আমরা গালাগাল করব মিডিয়ায়,
আর বাসে, ট্রেনে, মেট্রোয় মেয়েরা কেন
জেনারেল সেকশনে এই বলে ঝগড়া করব।
'এই জন্যেই তো এরা মরে।' বলে রাগ করব।

দামিনী, আমরা তোমাকে বলব,
'Do not resist! Enjoy!!'
এই বিজ্ঞাপনের সময়ে তোমার শরীর
তো শুধু পণ্য।
উপভোগ করতে শিখলে প্রাণটা
তো বাঁচে।

বারাসাতের রাজীব দাস বোকা, আর এক
দামিনীর অপমান সে মানতে পারেনি।
দামিনী, বরুণ বিশ্বাসও পাগল ছিলেন,
নয়তো কেউ
শত শত দামিনীর অত্যাচারের
প্রতিবাদ করে একা?!
ওরকম বিপজ্জনক পাগল তাই
গুলিতেই মরবে বারবার।
আর আমরা তাঁর নামাঙ্কিত
বাজারি সিনেমা দেখে হাততালি দেব।

আমরা কিন্তু বেশ ঝকঝকে স্মার্ট
খুব তাড়াতাড়ি তাই
গণধর্ষণ ভুলে IPL, ৩৭৭ ধারা ইত্যাদি
নিয়ে মেতে উঠেছি।
আমাদের স্মার্ট চামড়ায় প্রলেপ
এক একটা কামদুনি, বারাসাত,
বদায়ুন, লাভপুর।
আস্তে আস্তে পুরু হচ্ছে স্তর -
একদিন গণধর্ষণও আমাদের
কাছে অত্যন্ত স্বাভাবিক হবে দামিনী।
আর আমরা শিল্পীর কাজ শুধুমাত্র
শিল্পসৃষ্টি বলব।

আবার আবার প্রতিবাদে ব্লগ করব বা
মৌনমিছিল মোমবাতি হাতে।
দামিনী, বিশ্বাস কর আমরা সবাই
তোমার পাশে আছি।
ঘরে আগুন লাগলেও কেউ না কেউ
নেভাবে ভেবে
আমরা দিব্যি পাশ ফিরে শুয়ে আছি।

একটু ভাবুন আমরা কি করতে পারি, আমরা সবাই... এই প্রসঙ্গে আপনার স্বাধীন মতামত জানান আমাদের ব্লগে অথবা আমাদের কাছে ই-মেল করুন info.amarbanglavasa@gmail.com

নির্ভয়া স্মরণে,
সম্পাদক-নবপত্রিকা

No comments:

Post a Comment