তখনও নন্দিনী রাগ করে বসে আছে সোফার ওপর। অনেক পছন্দ করে কিনেছিল এই জামদানিটা, কিন্তু এখন তা অনেকটাই আগোছালো, নেমে এসেছে মলিনভাবে। চুপ করে বসে আছে, রাগে হয়তো ঘৃণায় কোনও কথা বলতে চায় না। মেঝের ওপর হাতের দুটো বালা পড়ে আছে। দেখতে দেখতে, নরম হাতের ছোঁয়ায় কানের দুলগুলো খুলে ফেলল, হাতের মুঠোর মাঝে শক্ত করে ধরে রেখেছে; জানেনা সেগুলো নিয়ে ঠিক কি করবে। এলোমেলো চুল নেমে এসেছে ঠোঁটের ওপর, অবিন্যস্ত। কাজলের দাগ হাতের আঙ্গুলের স্পর্শে নেমে এসেছে চোখের কোলে, ভেজা ভেজা গালে তখনও লেগে জলের দাগ। যেন প্রচণ্ড অভিমানে সব গুঁড়িয়ে দিতে চায়। বারে বারে ঠোঁট ফোলাচ্ছে , কিন্তু সঞ্জীবের তিকে তাকানোর ইচ্ছে আর নেই।
বিধান সরণীর জ্যামে যখন গাড়িটা আটকে আছে, নন্দিনী তখন ভাবছে, আগের সন্ধ্যেবেলার সেই কথা, যখন রাগ আর অভিমানে সে দূরে সরিয়েছিল সেই মানুষটাকে যে আজ আর হয়তো...... গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে বার বার সঞ্জীবের মুখটা মনে করছে। তখন বাজে সকাল দশটা। চোখ মুছে, নিজেকে সংযত রেখে গাড়ি নিয়ে ছুটল ক্রসিং পেরিয়ে।
নন্দিনীর মনে পড়ছে এক একটা মুহূর্তে কথা। রাস্তার কালো পিচ গলে যাচ্ছিল, ঝাপসা চোখের জলে, যখন গাড়িটা ছুটছিল ভি আই পি রোড ধরে।
"আজকে আমার শরীরটা ভালো নেই, কালকে ভোরবেলা ফ্লাইট আছে। আমি চেষ্টা করেছিলাম নন্দিনী।", সঞ্জীব অনুনয়ের সুরে বলতে চাইল। কিছুটা চুপ থেকে আবার নন্দিনীর দিকে করুণভাবে তাকালো। "নন্দিনী, আমাকে ভুল বুঝো না। আমি......" সঞ্জীবের কথা হারিয়ে যাচ্ছিল, প্রচণ্ড জ্বরে কথা বলার অবস্থা পর্যন্ত নেই, তবু বুঝতে দিতে চায়না নন্দিনীকে। ভীষণ ইগো, তাই কারও করুণার পাত্র হতে চায়না, সঞ্জীব। কিন্তু এখন যা ঘটেছে, সেটা সেও মানতে পারছে না।
"বেড়িয়ে যাও ঘর থেকে..." নন্দিনী ফুঁপিয়ে উঠল চিৎকার করে। চোখ মুছে, ভাঙা গলায় ধীরে ধীরে বলল, "আমার ভুল আমি বুঝতে পেরেছি। আমার জীবনের সব চেয়ে বড় ভুল। আমি আর এই সম্পর্কে থাকতে চাইনা। আমি বিশ্বাস করিনা, যে আমরা একে অপরের জন্য ভাবি। "
সঞ্জীবের অবস্থা তখন এতটাই খারাপ, যে উঠতে গিয়ে প্রায় টলে পড়ছে, কিন্তু বুঝতে দেয়নি। চোখের সামনে ঝাপসা, যখন অফিসে ফেরত শরীরের সমস্ত ঘাম জ্বরের উষ্ণ স্পর্শে উবে গেছে, যন্ত্রণায় মাথার রগ ছিঁড়ে যাচ্ছে, তবু বারবার বোঝাবার চেষ্টা করছে নিজেকে। হেরে গেলে চলবে না। সংসারের যন্ত্রণার কাছে তখন শারীরিক এই কষ্ট অনেকটাই লঘু মনে হচ্ছে। কাছে এসে দাঁড়িয়ে, বালা দুটো মেঝে থেকে কুড়িয়ে রাখল আয়নার সামনে।
"নন্দিনী, এতটাই ঠুনকো আমাদের সম্পর্ক? কি করিনি তোমার জন্য। এই সব কিছু তো তোমার? তোমার জন্য সকাল থেকে উদয় অস্ত খেটে চলেছি, আর তুমি ভাবছ যে আমি তোমার ভালো মতো... নন্দিনী বোঝার চেষ্টা করো। আমার চাকরির অবস্থা ভালো নয়। আমি অসহায়ভাবে খেটে চলেছি, শুধু নিজের জন্য নয়। তোমার জন্য, আমাদের আগামী..." সঞ্জীবের কথা জড়িয়ে আসছিল। খানিকটা থেমে, নন্দিনীর হাতের ওপর হাত রেখে, "আমাকে যে করেই চাকরিটা বাঁচাতে হবে। আমি জানি, আমি সময় দিতে পারিনা। আজকেও পারিনি। একটা মিটিং...।" ওর নিজের ওপরও ঘেন্না হছিল। আজকেও সে কথা রাখতে পারেনি। অনেকগুলো "না পারার" মধ্যে আজকেও সে পারেনি তার স্ত্রীর আবদার রাখতে। আজ ওর জন্মদিনে বাইরে যাবার কথা ছিল।
মানুষটা দিনে দিনে অপারগ হয়ে গেছে। রিশেসনের বাজারে, তখন "হ্যাঁ" তে "হ্যাঁ" মিলিয়ে না গেলে পরিস্থিতি কি হতে পারে, সঞ্জীব জানে। সংসার, লোন, ফ্ল্যাটের ইএমআই সব কিছু একা কাঁধে টেনে চলেছে, আর হয়তো সেটা করতে গিয়ে সংসারের কিছু চাওয়া - পাওয়া গুলো ধীরে ধীরে নজরের আড়ালে চলে গেছে। হয়তো সব দিক সামলাতে গিয়ে নন্দিনীর "খেয়াল" রাখতে পারছে না। একথা সঞ্জীবও জানে, কিন্তু জীবনের স্বাছ্যন্দ গুলো বজায় রাখতে নিজেকে নিঃশেষ করে দিতে চেয়েছে, নন্দিনীর মুখ চেয়ে। তাই কথাগুলো মানতে পারেনি।
গাড়ি তখন তীর বেগে ছুটছে, মেন রোড ধরে। নন্দিনী তখনও খবরটা বিশ্বাস করতে পারছেনা। ফোনটা সাইলেন্টে আছে, কিন্তু একের পর এক কল আসছে। কিন্তু তাতে ওর ভ্রুক্ষেপ নেই । সকালে মা ফোন করে খবরটা দেয়, প্রথম। মনে পড়ে যাচ্ছে সেই মুহূর্তের কথা, যখন সঞ্জীব অনেক করে বোঝানোর চেষ্টা করছিল আগেরদিন সন্ধ্যেবেলা।
"কতটুকু সময় দিয়েছ তুমি? আমাদের বিয়ের পর থেকে, শুধু, কাজ অফিস, মিটিং... তুমি পারনি কিছু করতে। আমি একটা ভালো সংসার চেয়েছিলাম, কিন্তু আমি তো একাই রয়ে গেছি..." নন্দিনী রাগে হাত সরিয়ে দিয়েছিল সঞ্জীবের।
সঞ্জীব বোঝাবার চেষ্টা করল, "আমি জানি, কিন্তু...তাই বলে তুমি ..."
"হ্যাঁ, আমি পারব। আমাকে পারতেই হবে, এতদিন একা থেকেছি, আগেও পারব।"
এই কথাটার পর, সঞ্জীব আর দাঁড়াতে পারেনি। আলাদা ঘরে শুয়েছিল সেদিন।
গাড়িটা যখন লেকটাউন পার হচ্ছে, তখন নন্দিনীর মনে পড়ছে কাজের দিদির কথা। "দাদা বাবু সারাটা রাত এখানে বাইরে শুয়েছিল সোফায়, আমি তোমাকে ডাকতে গেছিলাম, কিন্তু আমাকে মানা করল। জ্বরে পুড়েছে সারাটা রাত। একটুও ঘুমোতে পারেনি। শুধু ভোরবেলা যাবার আগে এই বাক্সটা দিয়ে গেছিল, বলেছিল তোমাকে দিয়ে দিতে। "
নন্দিনী পারেনি ওর দেওয়া শেষ উপহার ফেরাতে, ওর জন্মদিনের জন্য কিনেছিল সাধ করে হয়তো। কিন্তু গত রাতের ওই ঘটনাটার পর লজ্জায় অভিমানে আর দিতে পারেনি। আজ ওর আঙ্গুলের ফাঁকে আংটিটা রয়ে গেছিলো, কিন্তু মানুষটা হারিয়ে গেছিল।
সকালে যখন প্রথম ফোনটা এলো , নন্দিনী কিছুক্ষণ ঘোর কাটাতে পারেনি। সারাটা রাত প্রায় আধোঘুমে কেটেছে, বারে বারে ভেবেছে রাগে অভিমানে কোনও ভুল করে বসছে কিনা। সত্যিই এতবড় কথা বলা উচিত ছিল কিনা। হয়তো কয়েকবার বালিশের ওপর নরম গাল রেখে ফুঁপিয়েছে দুঃখে, ভেবেছে ভুলের কথা; মাঝরাতে অনেকবার ভেবেছে দরজা খুলে একবার দেখার কথা, কোথায় গেল মানুষটা। কিন্তু ইগো। হায়! দরজার একটা সামান্য আস্তরণ পেরতে পারেনি দুটো মানুষ, যারা একদিন ভালবেসেছিল, ঘর বেঁধেছিল নিজের ইচ্ছায়। বারে বারে মনে পড়েছিল, সঞ্জীবের কথাগুলো। ভেবেছিল ক্ষমা চাইবে। কিন্তু সকাল হতেই শুনেছিল, সে চলে গেছে। একবারের জন্যও দেখা করেনি স্ত্রীর সাথে।
আর তার পর বেলা বাড়তেই সেই ফোন। আলুথালু শাড়িতে ছুটে গেছিল টিভির সামনে, যখন নিউজে প্লেন দুর্ঘটনার খবর বার বার ভেসে উঠছিল। "ব্যাঙ্ককগামী এম-৪৭০... " খবরটা শেষ হবার আগেই জ্ঞান হারায় নন্দিনী। পরে কাজের দিদি এসে কোনও রকমে চোখ মুছিয়ে শান্ত করে। একরকম জেদ করেই বেড়িয়ে পরে গাড়ি নিয়ে, এয়ারপোর্টের দিকে।
কোনদিনও এরকম দৃশ্য দেখেনি সে। পুলিশের বড় ব্যারিকেড পেরিয়ে যখন পৌছালো ইনকয়েরি কাউন্টারের সামনে, তখন অগণিত মানুষের ভিড়। কেউ বারেবারে জিজ্ঞেস করছে সত্যি তার প্রিয়জনের বাঁচার কোনও আশা আছে কিনা। কেউ কাঁদছে, কেউ ফোনে ঘন ঘন কল করছে। কেউ শুধু নিথরভাবে বসে আছে বেঞ্চের ওপর। নন্দিনীর ভয়ে গলা বুজে আসছিল। একটা বড় ড্যাশবোর্ডে যাত্রীতালিকা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। অগণিত আঙ্গুল তাতে খুঁজে বেড়াচ্ছে তাদের পরিচিতের নাম। কেন জানিনা, নন্দিনী কাঁদতে পারছিল না। খুব চেষ্টা করছিল, কিন্তু পারছিল না। খুব চেষ্টা করছিল ফেটে পড়তে, কিন্তু পারছিল না যখন সঞ্জীবের নাম দেখতে পেল লিস্টে।
সেদিন অনেক কষ্টে গাড়ি চালিয়ে ফিরেছিল বাড়ি, মা বাবা তখনও কোলকাতায় এসে পৌঁছায়নি। এখনও জানেনা কিভাবে এতটা রাস্তা ......মনে পড়ছিল সেই রাগের কথাটা "তোমাকে ছাড়া পারব...পারতেই হবে..."।
যখন সদর ঘর পেরিয়ে ভেতরের ঘরের দিকে যাবে, দেখতে পেল সঞ্জীব দাঁড়িয়ে আছে, ভেতরের ঘরে। ফোনে কথা বলছে, " আজ ভাগ্যের জোড়ে ...ফাইলটা বাড়িতে না ভুলে গেলে...হয়তো...আমার মোবাইলে চার্জ ছিল না তাই, এতটা কষ্ট পোহাতে হল তোমাদের।আই'এম ভেরি সরি।"
নন্দিনী যে পিছনে দাঁড়িয়ে আছে, সঞ্জীব দেখেনি। ফোনটা রেখে, পিছনে তাকাতে, নন্দিনী পারেনি দাঁড়িয়ে থাকতে।
সেদিন ওর বুকে মাথা রেখে অনেকক্ষণ কেঁদেছিল, ভেঙে পড়েছিল বালির মহলের মতো; নখের চাপে সঞ্জীবের বুক চিরে গেছিল, যখন নন্দিনীর চোখের জলে ভিজে গেছিল তার জামা। বার বার ছুঁয়ে দেখছিল সেই মানুষটাকে যাকে হারিয়েছিল কিছু মুহূর্ত আগে। মুখ লুকিয়ে ছিল ওর কাঁধে মাথা রেখে। কথা বলতে পারছিল না, এতটাই ফোঁপাচ্ছিল। কান্না এসেছিল ওর ঠোঁটে। বার বার আঁকড়ে ধরছিল সঞ্জীবের পিঠ, রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছুঁয়ে দেখতে চাইছিল তৃষিত ডাহুকেরমতো। ওর শরীরের গন্ধ, সম্পর্কের উত্তাপ পেতে চাইছিল ফিরে, যা এক মুহূর্তে শেষ হয়ে যেতে বসেছিল। হয়তো বুঝতে পারছিল, "একা হওয়ার অনুভব একা হওয়ার কথা বলার চেয়ে অনেকটা কঠিন"। সঞ্জীব স্তম্ভিতভাবে শুধু দেখেছিল, শান্ত করতে চেয়েছিল ওর ঘন চুলের ফাঁকে আঙ্গুলে রেখে, ওর মাথায় হাত বুলিয়ে। যে মেয়েটা এক রাত আগে তাকে ছেড়ে যেতে চেয়েছিল, তার এত আকুল হবার কারণ বুঝতে পারছিল। আর যাই হোক, মনের অমিল হলেও ভালোবাসাটা যেন কোথাও রয়েই গেছিল। ওর মাথায় হাত রেখে আশ্বস্ত করেছিল, "তুমি যাই ভাবো, আমি আছি, আমি থাকব..."
ধন্যবাদান্তে,
সম্পাদক-নবপত্রিকা
সম্পাদক-নবপত্রিকা
Osadharon.
ReplyDeleteDurdanto.
ReplyDelete