"রান্নাটা বেশ ভালো হয়েছে কিন্তু, সবই কি......"
"সবই মাধবীর হাতের রান্না, ভালো লেগেছে তো?"
"অসাধারণ, এই রান্নাই চাই প্রতিদিন। তাই আমি গিন্নিকে বলেই দিয়েছি, এই মেয়েকেই আমি ঘরের মেয়ে করে নিয়ে যাব। আচ্ছা রিতমের যাওয়াটা...ও মাধবীকে নিয়ে চলে গেলে আমায় কে রান্না করে দেবে?"
"কে আবার? এতো বছর যে রান্না করে আসছিল, সেই গিন্নিই করবেন!" (ঘরের মধ্যে হাসির রোল দুই পরিবারের মাঝে)
"আচ্ছা, রিতম ঠিক কবে নাগাদ...?"
"এখনও দেরী আছে। শুভ কাজ মিটে গেলে, এই আগামী সেপ্টেম্বরে নিউ জার্সি চলে যাবে, একেবারে পাকাপাকি ভাবে।"
খাবার টেবিলে এপার আর ওপারের মধ্যে যখন অনেকটা এমনভাবে দুই পরিবারের মধ্যে প্রায় মিলনের সুর বাজছিল, তখনও দুটো মানুষ ছিল একেবারে চুপ। রিতম ঘন ঘন কল রিসিভ করেছে, হয়তো অফিসের ফোন, অথবা এই অস্বস্তিকর আলোচনা থেকে খানিকটা নিজেকে বিরত রাখতে বেড়িয়ে এসেছে "এক্সকিউস মি, আমি একটু আসছি, বসের ফোন" -এর অজুহাত দেখিয়ে। আর মাধবী আশ্রয় নিয়েছে, "আমি আরেকটু তরকারি নিয়ে আসি" এই কথা বলে, রান্নাঘরের অবগুণ্ঠনে নিজেকে লুকিয়ে। দরজাটাকে সপাটে বন্ধ করে ঘুলঘুলির দিকে চেয়ে থেকেছে অনেকক্ষণ। আসলে যে কুঠুরি থেকে এতদিন বেড়িয়ে আসার স্বপ্ন দেখছিল, সেই কুঠুরিটাই দিনে দিনে কেমন যেন তার আশ্রয় হয়ে যাচ্ছিল। এটা চতুর্থ সম্বন্ধ। তাই মা-বাবা মরিয়া চেষ্টা করেছে, যে করেই হোক, খুকুকে তার খেলাঘর থেকে দূর দেশে পাঠানোর জন্য। হয়তো এই সম্বন্ধ পাকাও হয়ে যাবে। আর সেই ভয়েই মাধবী কেমন যেন কুঁকড়ে যাচ্ছে। কলেজের দিনগুলোতে ঘরে মন থাকত না মাধুর। হ্যাঁ, ঠাম্মি শখ করে ডাকনাম দিয়েছিল, মাধু।
মাধু, বাড়ির চার দেওয়ালের বাইরেই খুঁজে পেত স্বাধীনতা, যখন এক মুঠো হাওয়া কথা বলতো ওর সাথে দুরন্ত বাসের জানলায়; যখন প্রসাধনী দোকানে অনেকক্ষণ পর বেছে নিত পছন্দসই কানের দুল, যখন বই পড়তে পড়তে আড়মোড়া ভাঙা বিকেলকে টেনে নিতে খুব কাছে- বালিশের ওপর রাখা "আরণ্যক"। মেঘলা দিনের কবিতা, জানালার গ্রিল বেয়ে নেমে আসা বৃষ্টির জলে ভিজে যাওয়া গানের বই, অথবা এলো চুলে কোনও কোনোদিন একলা দুপুরে গুনগুন "এই আকাশে আমার মুক্তি...", বা নেহাত একলা পায়ে পায়ে প্রিন্সেপ ঘাটের শেষ সিঁড়িতে অনেকক্ষণ - শুধু খেয়া পারাপারের কথা। বন্ধুরা ছিল, কিন্তু ছোটবেলা থেকে চুপচাপ এই মেয়েটার দুনিয়াটা বেশ অন্য রকম। তিলতিল করে ঘরের বাইরে বানিয়ে নিয়েছে আরেকটা মনের ঘর।
কিন্তু আজ কেন যেন, সেই মা-বাবার ঘরই যেন তার শেষ আশ্রয়ে পরিণত হয়েছে। তার মনের ঘরের কথা অন্য কেউ বোঝেনি। আর তার নিজের ঘর কেড়ে নিতে চেয়েছে তার বাবা-মা। দিনে দিনে মা-বাবার বার্ধক্যের বোঝা হয়ে গেছে মাধু। নিয়তি, কিম্বা সামাজিক নিয়মের কাছে বশ্যতা স্বীকার করলেও, প্রতি মুহূর্তে ছোট্ট সেই বিনুনি করা ঘরময় খেলে বেড়ানো মেয়েটার মতো ভেবেছে, "যদি আরেকটু সময় পাওয়া যেত। " যে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যাবার স্বপ্ন দেখেছে নিজের মনের উড়ানে, আজ কেন জানিনা তার মনে হয়েছে, "এটাই যেন তার অস্তিত্বের শেষ সম্বল।" নতুন সংসার, নতুন দায়িত্ব এই শব্দগুলো ভেঙে দিয়েছে তার আত্মবিশ্বাসের পাঁজর।
"না, এই জাস্ট বেড়িয়ে এলাম। পারা যাচ্ছিল না। এভাবে চললে দ্যাখ, আমি কোনদিন না বলে সকালের ফ্লাইটে রওনা হয়ে যাব। থাকুক তোর মা-বাবা সংসারের স্বপ্ন নিয়ে।", ছাদের একটা নির্জন কোণ দেখে সিগারেট ধরিয়ে নিলে, ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় পেতে চাইল নিঃশ্বাসের মুক্তি।
ফোনে ওপার থেকে দিদির বকুনি, "শোন রিতম, ছেলেমানুষি করিস না। বয়স কম হল না। আমি চাইনা তুই আবার কোনও ভুল পদক্ষেপ নিস।"
রিতমের কানে ধরা মোবাইল, আর নিবিড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে, দুপুরের নির্জন সর্পিল গলিগুলোর দিকে, বাড়ির উঁচু ছাদ থেকে বেশ দেখা যায় অনেকটা দূর অবধি। বেশ নির্জনে নির্বাক হয়ে ভাবার জন্য আদর্শ জায়গা।
একটু দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে দিদি আবার বলল, "ভুলে যা, যা ঘটে গেছে। পুরনো জিনিস আঁকড়ে থেকে লাভ কি বলতো? সঞ্চারী কি একবারও তোর সাথে যোগাযোগ করতে চেয়েছে শেষ কয়েকমাসে? আর সত্যি বলতে,আমার পক্ষে তোকে এইভাবে ভেঙে পড়তে দেখা সম্ভব নয়। অনেক হয়েছে"
"দিদি...একবার বোঝার চেষ্টা করো, আমি এখনও মানসিক ভাবে সব কিছু কাটিয়ে উঠতে পারিনি। প্লিজ, খুব ভালো হবে যদি আমি...?"
"রিতম! কেন এরকম বোকামো করছিস বলতো? এভাবে কতদিন চলবে? সম্পর্কে ভাঙা গড়া হতেই পারে। তার মানে এই নয় তুই সারাজীবন কারও জন্য শুধু অপেক্ষা করে যাবি। বাস্তবের মাটিতে পা রাখ। ভাবিস না এটা শুধু তোর জীবন, তুই যা পারলি করলি, আর বাকিরা শুধু দেখে গেল। এতটাও স্বার্থপর হয়ে যাস না। আমি মা কে তোর জন্য কান্নাকাটি করতে দেখেছি। মাও খুব কষ্ট পেয়েছে, সব কিছু জেনে। তাদেরও কিছু চাওয়া পাওয়া আছে তোর থেকে..."
রিতম শুধু চুপ করে শুনে যাচ্ছিল, কিছু কথা বিষপানের মতো করে মেনে নিতে হচ্ছিল; আর নিঃশ্বাসের প্রতিটি ধোঁয়ায় তার চাওয়া- পাওয়া, দ্বিধা, রাগ, ঘেন্না, অপবাদ, অতীত, অস্তিত্ব -সবকিছুকে বিদায় জানাচ্ছিল।
কলটা রাখতেই লক্ষ্য করল একটা এসএমএস- "আমি কিছু কথা বলতে চাই।" মাধবীর। রিতম কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দিল, "সবার খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলে, আমি সবার থেকে তোমার সাথে কথা বলার অনুমতি চেয়ে নেব।"
অবশেষে রোদ্দুর মাখা রবিবাসরীয় বিকেলে, সেই দুটো মানুষ অবশেষে এক ঘরে। কিন্তু দুপুরের দুই'পরিবারের কথোপকথনের গুঞ্জন এখনও ওদের তাড়া করে চলেছে। রিতম লক্ষ্য করল, মাধবীর নির্বাক দৃষ্টি সেই রোদের ফালার ওপর যেটা সূর্য ঢলে পড়ার সাথে সাথে তার পায়ের পাতার দিকে এগিয়ে আসছে।
খানিকক্ষণ অপেক্ষা করল মাধবীর জন্য, তার পর নিজেই বলল, "এভাবে চুপচাপ বসে থাকলে, কথাগুলো অধরাই রয়ে যাবে।"
"বারান্দায় দাঁড়াবে?", মাধবী হেসে বলল।
রিতম তখনও প্রস্তুত নয় এই ধরণের কাছাকাছি আসার জন্য। রিতমের ধারণা, হয়তো মেয়েটা এখনও জানেনা যে এই ছেলেটা কোনভাবেই এই বিয়েতে সম্মত নয়। তাই হয়তো খেলাচ্ছলে, একটু আবদার বশত, নির্জনে ওর সাথে দেখা করতে চেয়েছে। বা হয়তো জানাতে চেয়েছে, তার পছন্দ অপছন্দের কথা। বিয়ের আগে এই ধরণের আলোচনা দুটো মানুষের মধ্যে হয়েই থাকে। নিজেদের অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ কে আরেকবার ফিরিয়ে দেখানো একে অপরের কাছে। অন্যভাবে বলতে গেলে, একে অপরের কাছে সমস্ত সত্য বলে রাখা, যাতে ভবিষ্যতে কোনও সমস্যা না আসে। অন্য বন্ধুদের সম্বন্ধ হবার সময় রিতম দেখেছে এই প্রকারের প্রথা। কিন্তু একদিন তারও যে এই রকম দিন আসবে, সেটা এক বছর আগেও কখনও ভাবেনি। ভাবার দরকারও পড়ত না যদি সঞ্চারী এভাবে মুখ ফিরিয়ে না নিত।
রিতম অস্বস্তি সত্ত্বেও বাধা দিল না। মনে মনে ভেবে রাখল, নিজের মনের সত্যি কথাটাও বলে ফেলার জন্য।
বারান্দার রেলিঙে হেলান দিয়ে প্রথম নিঃশ্বাস নেবার পরই রিতমের দিকে তাকিয়ে মাধবী বলল, "আমি এই বিয়ের জন্য প্রস্তুত নই। "
কথাটা বলার পরই মাথা নিচু করে পায়ের পাতার দিকে বেশ কিছুক্ষণ থাকিয়ে থেকে বলল, "এটা বলা ভুল, যে মা বাবা আমার জোর করে বিয়ে দিচ্ছে, কিন্তু আমি আরও সময় চাই, আমি আরও অনেক কিছু করতে চাই। "
রিতম মুচকি হেসে ফেলল আর হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে থাকলো মাধবীর মুখের দিকে, যখন সোনালী আলো ছুঁয়ে যাচ্ছিল ওর গাল বেয়ে নেমে আসা সদ্য কেনা নতুন কানের দুল। মাধবী বেশ আশ্চর্য ভাবে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল, "তুমি বুঝতে পেরেছিলে? বিশ্বাস করো, তোমার মধ্যে কোনও খুঁত নেই। তুমি ভালো ছেলে। ভালো চাকরি, হয়তো সুখেই রাখবে। যেকোনো মেয়েই তোমাকে স্বীকার করে নেবে নিজের স্বামী হিসেবে। কিন্তু..."
"না না, সেটা ভুল বলা হবে। আমি কখনও বলিনি বা সন্দেহও করিনি যে, তুমি আমাকে না বলতে চলেছ। আমি হাসছি অন্য কথা ভেবে। "
"কি কথা?"
"আমিও তো একই কথা বলব ভেবেছিলাম। কিন্তু সত্যি বলতে নিজেও ভেবে উঠতে পারছিলাম না, কিভাবে তোমাকে বলব..."
মাধবী, আর রিতম দুজনেই বেশ আশ্বস্ত অনুভব করল। কিন্তু নেহাত নারীসুলভ কৌতূহল থেকে জিজ্ঞেস করল, "তা রিতম, তোমার কারণটা জানতে পারি? আমি বুঝি, মেয়েরা বিয়ে পণ্যের মতো, একজনের পছন্দ না হলে..."
রিতম কথাটা থামিয়ে বলল, "মাধবী..যদি আমার জীবনের কিছু ঘটনা না ঘটত, তাহলে হয়তো তুমিই আমার সঙ্গী হতে আজীবনের জন্য। এটা ভাবার কোনও কারণ নেই যে মেয়েরা বিয়ের পণ্যের মতো। আমরা আর 'সেই' সমাজে বসবাস করিনা। বা আমি ব্যক্তিগতভাবে সেই মানসিকতার নই। তুমি শিক্ষিত, স্বাধীনচেতা, আর আজকের পর বলা উচিত, সাহসী। তোমাকে না বলা, হয়তো নেহাতই বোকামো। কিন্তু আমি অপারগ। আমি জানিনা, আগের যারা তোমায় দেখতে এসেছিল, তারা কি বা কোন কারণ দেখিয়েছে। কিন্তু, আমি তোমায় অন্ধকারে রাখতে চাই না। যাতে তুমি নিজে বিশ্বাস করতে পারো, যে আমি তোমায় প্রত্যাখ্যান করিনি। কিন্তু নিজেই সরে যেতে চেয়েছি।"
মাধবী রিতমের চোখের দিকে তাকিয়েছিল অনেকক্ষণ, বোঝার চেষ্টা করছিল তার মনের অবস্থা। আগের প্রতিটি ক্ষেত্রে, ছেলের বাড়ির লোকজন ফোন করে সম্পর্ক ফিরিয়ে দিয়েছে, কোনও কারণ বিশেষ ভাবে না বলে। এটাই হয়তো প্রথম, যখন সামনা সামনি কেউ তাকে "না" বলছে। কিন্তু অন্তরে অন্তরে "ফেলনা" হয়ে যাবার কুণ্ঠা আর লজ্জাও দানা বেঁধে উঠছিল। আসলে গতবারের "না" শোনার থেকে এবারে মাধবী নিজে "না" বলতে চেয়েছিল। এইসব সামাজিক "মেকী" অনুষ্ঠানের থেকে বিতৃষ্ণা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে চেয়েছিল এই সম্বন্ধ থেকেও, যাতে মা-বাবা অন্তত কিছুটা সময়ের জন্য তাকে সময় দেয়। বললে আশ্চর্যের নয়, বিয়ের বাজারের কেনাবেচা, সম্পর্কের দরদাম থেকে বিরত রাখতে চেয়েছিল নিজের নারী হবার অনুভবকে। একটা বিয়ে যেন তাকে আরও না অপারগ করে ফেলতে পারে, তাই নিজেকে গুটিয়ে ফেলছিল।
হয়তো মনে মনে চেয়েছিল, রিতম ভেঙে পড়ুক এই "না" শুনে, কিন্তু তা হয়নি। বরং আশ্চর্যের সাথে, আরেক দলছুট পাখির সাথে দেখা হয়ে গেছিল মাধবীর, যে তারই মতো ভাবত।
"সঞ্চারীর সাথে আমার সম্পর্ক ছিল গত চার বছর। কিন্তু রিসেসনের সময় আমার চাকরির অবস্থা একটু খারাপ হয়। বাবাও রিটায়ার করেছিল। নতুন বাড়ি করছিলাম, কিন্তু সেটাও প্রায় অর্ধেক তৈরি অবস্থায় ছিল। অনেক দেনাও ছিল ঘাড়ে। বাধ্য হয়ে আমাকে নতুন চাকরি খুঁজতে বেরোতে হয়। সংসারের অবস্থাও খুব একটা ভালো ছিল না। কিন্তু সঞ্চারীর পরিবার থেকে বিয়ের জন্য চাপ আসতে থাকে। আমি হন্যে হয়ে ঘুরছিলাম, চাকরি আর দেনার চাপ থেকে রেহাই পেতে। ওকে অনেকবার বোঝানোর চেষ্টাও করেছিলাম, বলেছিলাম আমাকে একটু সময় দিতে। আসলে নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে, কি করে আরেকটা মেয়ের জীবনের দায়িত্ব নেব? আমার নয় যা হবার হল, কিন্তু তার? আমি যদি তার শখ আহ্লাদ ইচ্ছে না পূরণ করতে পারি অর্থাভাবে? এই ভাবনাগুলো কুড়ে কুড়ে খেত।"
মাধবী চুপ করে রিতমের দূর আকাশের দিকে চেয়ে থাকা চোখের দিকে তাকিয়ে শুনছিল, আর মনে মনে সহানুভূতি অনুভব করছিল এই মানুষটার জন্যও-যেমন জাগে তার নিজের জন্য।
"জানো মাধবী! ও বলেছিল অপেক্ষা করবে, কিন্তু পড়ে জানি, ও নিজের মতেই এই সম্পর্ক থেকে বেড়িয়ে আসতে চেয়েছে। আচ্ছা, ভালোবাসা মানে তো, সবকিছু সত্যি ভাবে একে অপরের সাথে ভাগ করে নেওয়া। প্রেম মানে তো শুধু দেওয়া নেওয়া নয়, তার মানে তো আমি জানি একে অপরের পাশে দাঁড়ানো! একে অপরের সম্বল হয়ে ..."
শেষ করার আগেই মাধবী বলল, "একে অপরকে বুঝে নেবার ক্ষমতা। কিন্তু তুমি আর সঞ্চারীর সাথে যোগাযোগ করেছিলে? ওর সাথে কথা বলতে চেয়েছিলে? জানতে চেয়েছিলে, এর বাইরে অন্য কোনও কারণ"
এরকমই হয়তো কোনও বন্ধু চেয়েছিল, যার সাথে রিতম কথা বলতে পারবে। মনে মনে বেশ ভালো লাগছিল, বাঁধন ছাড়া হয়ে ওর সাথে কথা বলতে। আসলে বন্ধু হলে কুণ্ঠাবোধ বোধহয় কমে যায়। রিতম চশমাটা খুলে, আর্দ্র হয়ে আসা চোখ কচলে নিল। চশমাটা পড়ে বলল, "নাহ! আমার না পারার লজ্জাটা শুধু আমারই। এখন আসতে আসতে পায়ের ওপর দাঁড়িয়েছি। মা বাবা- আমার বিদেশ যাবার কথা সবাইকে বড়াই করে বলে বেড়াচ্ছে। ভাবছে, এই বলে কোনও সম্বন্ধ তাড়াতাড়ি করা যায়। আচ্ছা, তুমিই বলও, কেউ যদি আমার গুনগান করে বেড়ায়, তাহলে কোনও মেয়ে আমাকে না বলবে? তুমি আলদা মানুষ, সেটা আমি বুঝেছি। কিন্তু আশ্চর্য হল, কেন আমরা একে অপরের ভালগুলো নিয়ে এতো আলোচনা করি? কেন, আমাদের খারাপ গুলো, আমাদের কষ্ট গুলো আগে থেকে ভাগ করে নিই না? আমার চাকরি, আমার প্রতিপত্তি এসব কি আমার পরিচয়, নাকি আমি রিতম, আমি লিখতে ভালোবাসি, আমি ঘুরতে ভালোবাসি- এইটা আমার পরিচয়? মানুষ রিতমের পরিচয়"
মাধবী অনেকটা নিজেকে কাছাকাছি মনে করছিল রিতমের। কাছে এসে দাঁড়িয়ে বন্ধুর মতো আঙ্গুলগুল ধরে বলল, " এভাবে ভেবো না! আসলে ভালো হবার মোড়কে আসলে মানুষগুলোকে আমরা কোনোদিন খুঁজে দেখিনা..আমি এই রোজের পুতুল খেলা থেকে বেরোতে চাই। আমি চাই না, এই ঘন ঘন নতুন কোনও পুরুষের চোখ আমাকে পরিপূর্ণতার মাপকাঠিতে মেপে দেখুক। আমি অনেকটা সময় চাই দূর কোথাও। দলছুট হতে চাই, সমাজ, নিয়ম সব কিছু ফেলে মেয়েবেলায় ফিরতে চাই। নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে চাই।"
রিতম তাকিয়ে ছিল মাধবীর ঠোঁটের দিকে, যখন আনমনে অনেক কথা নেমে আসছিল ওর হৃদয় থেকে। "তোমার কি কি ভালো লাগে? বলবে?"
মাধবী লাজুকভাবে কানের পাশ দিয়ে চুল টেনে নিল কানের পিছনে, আর কানের সেই দুলগুলো ছুঁয়ে গেল ওর লাল হয়ে যাওয়া গাল। বেশ কিছুক্ষণ থেমে হেসে বলল, " অনেক কিছু"। শাড়ির কষে বাঁধা আঁচল তা খুলে ফেলল কোমরের বাঁধন থেকে আর মেলে দিল হাওয়ার সাথে। খুব সন্তর্পণে গুটিয়ে রাখা বেণী খুলে ফেলল, মেলে দিল এলো চুল কাঁধের ওপর। আঙ্গুলের নরম স্পর্শে টেনে আনল কাঁধের একপাশে, এলিয়ে দিল বুকের ওপর। একটু এগিয়ে দুহাত বাড়িয়ে দিল আকাশের দিকে, "আমি স্বাধীন হতে চাই। কেউ পারেনি আমার স্বাধীনতাকে বুঝতে...না আমার মা-বাবা, না আমার বন্ধু, না সেই......", আবেগ তাড়িত হয়ে থেমে বলল, "সত্যি বলছি, আমি ভিতু, নতুন কিছুতে আমার ভয় হয়। আমি সাহসী হতে চাই। "
রিতম আশ্চর্য হয়ে দেখছিল সেই লাজুক মেয়েটার দিকে, যে বারে বারে ঢুকে গেছিল রান্নাঘরে লোকদৃষ্টি এড়ানোর জন্য। মাধবী খুঁজে পাচ্ছিল সেই বন্ধুকে, যে ফোনের বাহানায় এড়িয়ে গেছিল পরিবাবারের লোকজনের কথা।
বেশ খানিকক্ষণ, নির্বাক কাছাকাছি দুজনে দাঁড়িয়ে থাকার পর, মাধবী জিজ্ঞেস করল, অস্তগামী সূর্যের দিকে তাকিয়ে, "সন্ধ্যে হয়ে এলো তো, নিচে সবাই অপেক্ষা করছে। কি বলি বলতও?"
"তোমার যা মনে হয়। বলে দাও, ছেলে ভালো নয়। এই ছেলে আমার পছন্দ নয়। অন্যবার তারা তোমাকে না করেছে। এবার নাহয় তুমি করলে। "
মাধবী একটু ভেবে ফিরে তাকালও, "কিন্তু..."
"কিন্তু কি?", রিতম কৌতূহল চাপতে পারল না।
একটু থেমে এগিয়ে এসে রিতমের চোখে চোখ রেখে মাধবী জিজ্ঞেস করল, "আমাদের আবার দেখা হবে তো?"
সম্পাদক-নবপত্রিকা
বেশ!!
ReplyDelete