Code

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

Second Header

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

Wednesday, February 10, 2016

গল্পের মত


মাথাটা বেশ ভারি ভারি লাগছিল। ঠোঁটের কোণে অল্প লালা জমে এসেছে।এত গভীর ঘুম অনেকদিন হয়নি; এমনকি খুব ক্লান্ত হয়ে শোয়ার পরও কেউ এতটা অচেতনভাবে ঘুমোতে পারেনা। গতকাল অফিসে স্ট্রেস ততটা ছিল না, কিন্তু ঘুম থেকে উঠে বেশ গা ম্যাজম্যাজ করছিল।আগের রাতে অতটাও ড্রিঙ্ক করেনি, যে এতটা ঝিমঝিম লাগবে। বালিশের ওপর এলো চুল ঝর্নার মত বয়ে এসেছে। বেশ অলসতার সাথে নখ দিয়ে আঁকড়ে ধরল বালিশ, আর ঠোঁটের ওপর লুটিয়ে আসা ঘন চুলের শামিয়ানা সরিয়ে মিটমিট করে তাকালও ঘড়িটার দিকে। মিতালীর আজ একটুও অফিস যেতে ইচ্ছে করছে না। তার ওপর আজ আবার শুক্রবার। কোনওমতে আজকের আট ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে পারলে, ব্যস! দুটো দিন পুরো ছুটি। ঘুমিয়ে-আড্ডা মেরে কাটিয়ে দেওয়া যাবে। আর বন্ধুরা জুটে গেলে, লেট নাইট পার্টি কারো বাড়িতে, অথবা ড্যান্স লাউঞ্জে। মাথাটা তুলে, পিঠের ওপর ছড়িয়ে রাখা চুল টেনে নিল কাঁধের এক পাশে, আর মোবাইলটাকে টেনে নিল বুকের খুব কাছে। আধো ঘুম চোখে দেখতে 
থাকল সারা রাতের আপডেট- তা সে নিউজ অ্যাপের গরমাগরম ব্রেকিং নিউজ হোক, অথবা ফেসবুকে কারো জন্মদিন, অথবা চ্যাট অ্যাপে বন্ধুদের নিশি-গুলতানি। আরেকটা জিনিস চোখে পড়ল, মেসেঞ্জেরের একটা পিং। সেই নামহীন ছেলেটা, যার প্রোফাইলে এখনও কোনও ফটো আপডেট নেই। দেখার আগেই বন্ধ করে দিল মোবাইল ফোন। এরকম, কত মানুষ মুখিয়ে থাকে মিতালীর সাথে দেখা করা, কিছু সময়ের জন্য কথা বলার জন্য; আরও ভাল ভাবে বলা উচিত, তার সান্নিধ্য পাবার জন্য- সেটা "যেই রকমেরই" হোক না কেন। যদিও এই ছেলেটার "গল্প" একটু আলাদা। খুব বেশিদিন হয়নি আলাপ হয়েছে, বেশ রহস্যময়। কথায় কথায় বেশ মিশে গেছে বন্ধুর মত। কিন্তু মিতালীর সন্দেহ একটু হলেও রয়ে গেছে, যদিও তার চেয়ে বেশি কিছু আশা করেনি। ছেলেটা শুধু "গল্পের" কথা বলতও, বলতও "তোমার আশে পাশের প্রতিটি চরিত্র এক একটা গল্প বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। কারও হয়তও ভাঙা গড়ার গল্প, কারও হয়তও প্রতি রাতের বিছানায় নিজেকে শেষ করে দেবার গল্প, কারও হেরে যাওয়ার গল্প, কারও বা বৃষ্টির দিনে নীরবে চলে যাবার গল্প, কারও বা একলা ছাদে দুহাত বাড়িয়ে মুক্তির সাথে ঠোঁট মিলিয়ে দেখার গল্প, কারও রোজ রোজ সংসারের চাপে নিভে যাবার গল্প...সারা দুনিয়াটা এতো সুন্দর, এতো কথা...কখনও ভেবে দেখো।" মিতালী বিশ্বাস করেনি, এমন "ভাল ভাল" কথা অনেকে বলে। সবার কথায় এতো সময় দেওয়া অসম্ভব। এটা ভুল যে মিতালীর কথাগুলো ভাল লাগত না, কিন্তু কোনদিনও গভীর ভাবে ভেবে দেখেনি।

দূরের জানালা থেকে একটু খানি আলো এসে পড়েছে বিছানার ওপর। কিন্তু অন্ধকার ছায়াটা যেন আর বেশি প্রিয় লাগছিল ওর। কিন্তু উঠে তো পড়তেই হবে, নাহলে অফিসে গিয়ে হাজারও বাহানা। পর্দাটার দিকে আরেকবার তাকিয়ে, একরাশ অনিচ্ছা নিয়ে উঠে পড়ল বিছানা ছেড়ে। টিক টিক শব্দে ঘড়িটা তখন সময় জানাচ্ছে সকাল ন'টা। "ইস, আজ আবার দেরি হবে মনে হচ্ছে", নিজেই মনে মনে বলতে থাকল। রাতের আলতো পোশাক পরে কফির কাপ হাতে বেরিয়ে এলো বারান্দায়, একটু প্রাণ খুলে শ্বাস নেবার জন্য। সকালের শিরশিরে হাওয়া তখন বেশ আশ্চর্য একটা নিস্তব্ধটা ছিল চারপাশে, মনটা খুব স্থির হয়ে এলো, একটা বেশ প্রশান্তি মনে জাগছিল। হাল্কা টাইটান আইএর চশমা, সবুজের আভা ছড়িয়ে আছে তার ফ্রেমে, নিপুণভাবে আগলে রেখেছে দুটো চোখ। স্টাইলিশ নথ হেলে পড়েছে নাকের লতি দিয়ে। লম্বা চুল নেমে এসেছে বুকের ওপর। ঠোঁটের ওপর আলতো ভেজা কফি-মার্ক। কানে ডিজাইনার দুল, বার বার এলিয়ে পড়ছে ওর প্রত্যেক নিঃশ্বাস আর ভাবনার সাথে। কখনও তা ছুঁয়ে গেছে ওর পেঁজা তুলোর মত গাল, কখনও জড়িয়ে গেছে চুলের আড়ালে বাধ্য করেছে মিতালীর আঙুলকে বারে বারে কানের পিছনে ফিরে আসতে। কখনও বা বেখেয়ালে সেই সোনালি দুল মুখ লুকিয়েছে ঘন চুলের আলেয়াতে, কখনও নীরব চোখে উঠে এসেছে আরেকবার নতুন করে একটা দিন শুরু করার উচ্ছ্বাস। আড়মোড়া ভেঙে লক্ষ্য করল, আজ সেই পাখিদের দল আসেনি ছাদের কার্নিশে; অন্য দিন এই টবের কাছটায় এসে গুঞ্জনে ভরিয়ে তোলে চারপাশ, কিন্তু আজ হয়তও সেই একলা মেয়ের দেখা না পেয়ে পাড়ি দিয়েছে অন্য কোনও পথে। দূরের ছেলেদের মেসের ছাদটাও আজ ফাঁকা, কোনও উৎসুক চাহনি খুঁজতে আসেনি তার প্রাতঃ-রমণীয়তার আস্বাদ। অথবা ওই বাড়ির সরকার গিন্নীর বাজখাই গলাও শোনা যাচ্ছেনা, নাহলে কত্তামশাইকে বাজারের হিসেব দিতে দিতে পাড়া মাথায় তুলত। নেমে আসার আগে, খেয়াল হল, আজকেও ছেলেটা খবরের কাগজ দিয়ে যেতে দেরি করেছে।

নীচে নেমে এসে স্নান করে তৈরি হয়ে নিল। সেলফোনটা একবার দেখে নিল, কোনও মিসড কলের জন্য। শাড়ি, হাল্কা লিপস্টিক, স্ট্রিং স্টাইলিশ ব্লাউজে ধরা তার নারীদেহের ভাস্কর্য। ফ্ল্যাটের সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসার সময়, একবারের জন্যও দেখতে পেলো না, ছোট্ট তুতুনকে, বাচ্চাটা এইখানেই খেলে গেটের বাইরে। আজ মনে হয় এখনও ঘুম থেকে ওঠেনি।"এতো বেলা অবধি তো ও ঘুমায় না, ওর মায়ের গলাও তো পাওয়া গেল না।যাক গে, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে, বেরিয়ে পড়ি। এখন তো পুল কারও পাওয়া যাবে না কারও সাথে। ট্যাক্সি বা এসি বাস ছাড়া মনে হয় গতি নেই।"

রাস্তাটা বেশ ফাঁকাফাঁকা দেখে বেশ সন্দেহ হচ্ছিল। "আজ কোনও বনধ নেই তো? কই? হলে তো গতকাল পিএনপিসি হত তাহলে...সেরকম তো কেউ কিছু বলল না। দেখি এগিয়ে, কি পাওয়া যায়"- মনে মনে বলল, তবে কোনও এক অজানা কারণে মনের মধ্যে একটা উৎকণ্ঠা জাগছিল।

রাস্তার মোড়ে এসে যা দেখল, তাতে কথা হারিয়ে যাবার মত অবস্থা মিতালীর। যে রাস্তা সকাল দশটার সময় ভিড়ে গিজগিজ করে, বাস আর অটোর জ্যামে যেখানে মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়, সেই রাস্তা একেবারে শুনশান। শুনশানের অর্থ হল- দূর দূরান্ত পর্যন্ত একটা মানুষেরও দেখা নেই।না আছে কোনও গাড়ির হর্ন, না কোনও স্কুলের জন্য ব্যস্ত পায়ে অপেক্ষমান ছেলেমেয়ের দল,না আছে খুচরো বাজার যা গমগম করে দোকানীদের চিৎকার আর খরিদ্দারদের দর কষাকষিতে, না আছে সেই বেলুনওয়ালা যার নিঃশ্বাসে ফুলে ওঠে হাজারও রঙের বাহার, নেই সেই আইসক্রিমের দোকান যার ঘণ্টা শুনে ভিড় করে আসে কচিকাঁচাদের দল। মিতালীর কেমন যেন একটা দমবন্ধ লাগছিল, ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে শুরু করল, যদি আগে গিয়ে "কিছু" দেখতে পায়, কারণ এখনও পর্যন্ত কোনও মানুষ তো দূর অস্ত, একটা কুকুর বা বিড়ালকেও দেখতে পায়নি কোনও খানে। আর দেখতে পেয়েছে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা সার দেওয়া ট্যাক্সি, কিন্তু কোনও মানুষ নেই। দু একটা ফাঁকা বাস, দাঁড়িয়ে আছে, চালকের আসন শূন্য। অথচ প্রতিদিন চোখের সামনের ফ্রেমে, এই সমস্ত কিছুই ভিড় করে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে, দ্রুত পায়ে প্রায় দৌড়াতে লাগল, চারপাশের সব কিছু যেন খুব অচেনা লাগছিল ওর কাছে। বন্ধ দোকানঘর, ফাঁকা বাসস্টপ, রাস্তার বুক জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য পাতার মড়মড়, হাওয়ার সাথে বয়ে আসা "একলা হয়ে যাবার গন্ধ"। গোটা শহর যেন মিতালীর শ্বাস প্রশ্বাসে মিশে যাচ্ছিল। থেকে থেকে শুনতে পাচ্ছিল তার নিজের নিঃশ্বাসের প্রতিধ্বনি, যা বারে বারে ঠিকরে আসছিল আসে পাশের খাঁ খাঁ করতে থাকা বাড়িগুলোর শূন্য বারান্দা থেকে। পাহাড়ের মত দাঁড়িয়ে থাকা আবাসনের জানালাগুলো এখনও অন্ধকার, রোদ্দুর যেন সেখানে প্রবেশ করতে পারেনি। এমনি দিনে সেখানে কখনও থাকতো ব্যস্ত পায়চারি, অথবা সকালের স্নানের পর কাপড় শুকোতে দেওয়া বাড়ির মেয়েরা, অথবা কখনও একান্তে ফোন ফোনে গল্প। কিন্তু কাউকেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মিতালী রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াতে লাগল, কেন করছে সেটা এখনও জানে না, কিন্তু পিছনের দিকে তাকালে তার ভীষণ ভয় করছে। এতো রোদের মধ্যেও সব কিছু যেন অন্ধকারের মত রহস্যময় লাগছিল। কান্না পাচ্ছিল ভীষণ, একটা জায়গায় আসার পর আর এগোবার ক্ষমতা বা ইচ্ছে দুটোই ফুরিয়ে এলো। একটা মোড়ে এসে পৌঁছাল যেখানে প্রায় চারটে রাস্তা এসে মিশে গেছে নদীর মত। বিহ্বলভাবে, এলোমেলো পদক্ষেপে রাস্তার মাঝখানে এসে দাঁড়ালো, মাথাটা কেমন যেন ঘুরছে। মুখের ওপর অজস্র ক্লান্তি আর অনিশ্চয়তার ছাপ যখন তার চোখ উন্মাদের মত খুঁজে বেড়াচ্ছে কোনও জীবিত অস্তিত্ব।ঘামে ভিজে গেছে পিঠ, রুমাল বার করে মুছে নিল গাল, তখনও ঘন ঘন শ্বাস চেপে রাখতে অক্ষম। বিশ্বাস হচ্ছিল না, এমনও কোনও দিন হতে পারে। এভাবে গোটা শহরটা একলা হয়ে যেতে পারে। আদৌ কি এটা সম্ভব। নাকি এটা পুরোটাই একটা ভ্রম।

"হয়তও এখনও আমি ঘুম থেকেই উঠিনি, নেহাত একটা দুঃস্বপ্ন। কিছুক্ষণ বাদেই আমি জেগে উঠবো", নিজেকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছিল।বারবার নিজেকে ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করছিল, দ্বন্দ আর ভ্রমের মিশেলে ধীরে ধীরে মানসিক ক্ষমতা হারাচ্ছিল।হঠাৎ খেয়াল হল মোবাইলের কথা। বিস্ময় আর ভয়ে তখন গলা বুজে আসছে মিতালীর, কাঁপা হাতে পাগলের মত খুঁজছিল ব্যাগের মধ্যে সযত্নে রাখা মোবাইল। হয়তও এইটাই এখন "বাকি" দুনিয়ার সাথে তার যোগসূত্র। ফোন বুক খুললেও, কোনও নাম কোনও নাম্বার খুঁজে পেল না। সমস্ত কন্টাক্ট কোথায় যেন হারিয়ে গেছে, জি পি এস কাজ করছেনা। শুধু লক্ষ্য করল, সেই না পড়া মেসেঞ্জেরের পিং-এর ওপর। ওটা এখনও "আনরিড" অপশনে পরে আছে।
"এ তো সেই নামহীন ছেলেটার মেসেজ; সকালে যেটা চরম অবহেলায় বন্ধ করে দিয়েছিল।কিন্তু ওর মেসেজ এখনও কি করে রয়ে গেল?" এই মুহূর্তে হয়তও ওইটাই বাকি দুনিয়ার থেকে মিতালীর জন্য কোনও শেষ বার্তা। মেসেজটা আগেই ফোনে স্টোর হয়ে গেছিল, তাই খুলে ফেলল এক নিমেষে, যাতে লেখা "একদিনের জন্য, তোমার আশে পাশে থাকা সমস্ত গল্প চুরি করে নিলাম। একবার দেখে নাও গল্পহীন পৃথিবীটা কেমন হয়।"


ধন্যবাদান্তে,
সম্পাদক-নবপত্রিকা

1 comment:

  1. খুব সুন্দর, ভালো লাগল, অসংখ্য ধন্যবাদ।

    ReplyDelete