Code

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

Second Header

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

Sunday, April 17, 2016

দেখা


**** আজকের দিনে ****

দুপুর সাড়ে তিনটে বাজে তখন, শীতকালের ঠিক এই সময়টায় দিনের দৈর্ঘ্য ছোট হয়ে আসে। তাই দুপুরের ঠিক পরপরই বিকেলের আমেজ ফুটে উঠতে থাকে। একটা বিশাল লম্বা করিডরের এক প্রান্তে একটা খোলা দরজা। সেখানে কাঁচের জানালার ওপর আলোর রেখাগুলো প্রতিফলিত হয়ে ঠিকরে পড়েছে মেঝেতে, ছড়িয়ে আছে অনেকটা অংশ জুড়ে। বাইরে কিছু লোকের ইতস্তত যাতায়াত, ছায়াময় অবয়ব এঁকে দিচ্ছিল সেই রোদের গুঁড়োর ওপর। শুনশান লবিটার একধার দিয়ে পরপর অনেকগুলো অফিসঘর। তার কোনোটাতেই লোক নেই। কয়েকটাতে আলো জ্বলছে, কয়েকটা তালা দিয়ে বন্ধ। ঘরগুলোর সামনে সার দিয়ে একটু একটু দূরত্বে ছোট বেঞ্চ রাখা আছে, আগত লোকজনের বসার জন্য। তার ঠিক পাশেই রাখা কিছু টব, যার গায়ে লাগানো আছে "মন ভাল করার, উদ্বুদ্ধ করার কিছু বাক্য"। গোটা লবিটার মধ্যে বসে শুধু একটা মানুষ। বরুণ। সাদা টানটান শার্ট, সঙ্গে মিশকালো প্যান্ট। দেখেচুল উল্টে আঁচড়ানও। মনে হবে, সদ্য অফিসের জন্য বেড়িয়েছে। কিন্তু হয়তও ইচ্ছের টানে পাল্টে গেছে তার গন্তব্য। হাতের খুব কাছে একটা ব্যাগ রাখা। কোলের খুব কাছে টেনে নিল সেটাকে যখন তার মুখ নেমে এসেছে চিন্তার ভারে। একবার তাকালও করিডরের আরেক প্রান্তের দিকে। একটা অফিস ঘর, এক মহিলার কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে এসে বসছেন অফিসের চেয়ারে আর কথা বলে চলেছেন তাঁর সহকর্মীর সাথে। মাঝে মাঝে টুংটাং ধাতব শব্দ আর মানুষের হাল্কা গুঞ্জনে ভরে আছে সমস্ত লবি। আর তারই মধ্যে বরুণ শুনতে পাচ্ছে তার নিজের দীর্ঘনিঃশ্বাস। খুব দৃঢ়ভাবে তাকিয়ে আছে নিজের পায়ের দিকে, যখন চিন্তার ঘাম নেমে আসছিল তার শক্ত চোয়াল বেয়ে। বার বার নিজেকে সংযত করছে। মনে মনে শুধু একটাই কথা বলে চলেছে, "আমাকে পারতেই হবে, ওর জন্য..."। ভাবনার পাকদণ্ডীতে ব্যস্ত তার আঙুল বারেবারে খেলে চলেছে সর্পিল ভাবে আপন মনে। স্থির থাকতে পারছেনা, তার উদ্বেগ আর অনিশ্চয়তা তাকে এতটাই ব্যস্ত রেখেছিল, যে থেকে পা নাচিয়ে চলেছিল বেঞ্চে বসে। কিন্তু একটা সময় আর বসে থাকতে পারল না। শরীরটাকে টেনে তুলল, আর আস্তে আস্তে এগোতে থাকল সেই অফিস ঘরের দিকে। পাশ দিয়ে কয়েকজন নার্স কথা বলতে বলতে চলে গেলেন। কিন্তু বরুণের তাতে কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। তার প্রত্যেক পদক্ষেপ তাকে মানসিকভাবে আরও শক্ত করে তুলছিল, বেড়ে চলেছিল হৃদস্পন্দন। এতদিনের অপেক্ষা তাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল অফিস ঘরের দিকে। প্রত্যেক নিঃশ্বাসের সাথে বেড়ে চলেছিল তার চলার গতি। ব্যাগটাকে কাঁধে নিয়ে স্বাভাবিকভাবে হেঁটে গেল কাউন্টারের সামনে। বরুণ জানত, "যে করেই হোক, ওর মা বাবা আসার আগে দেখা করতে হবে, না হলে..."

"দিদি, এখন দেখা করা যাবে?"

কাঁচের ওপারে বসে মধ্যবয়স্কা একজন সাদা পোশাক পরিহিত নার্স। বড় দেওয়াল ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে বললেন, "ভিজিটিং আওয়ার শুরু হতে এখনও মিনিট দশেক দেরী আছে।" খানিকক্ষণ কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে থাকার পর একটু থেমে বললেন, "ঠিক আছে।নাম বলুন"...এবার বরুণের মুখের দিকে তাকিয়ে একটু নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন, "পেসেন্টের নাম কি? নাম বলুন"
বরুণ এক মুহূর্তের জন্য কি যেন একটা খেয়ালে ছিল। কিন্তু সম্বিত ফিরে পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলল, "রূপসা ...... রূপসা মল্লিক"।

ভদ্রমহিলা কম্পিউটারে তথ্য যাচাই করার পর বললেন, "ভিজিটিং কার্ড এনেছেন? সেটা জমা দিন এখানে, আর সামনের সিঁড়ি দিয়ে চারতলায় পনেরো নম্বর বেডে চলে যান।"

"দিদি, আমি ভিজিটিং কার্ডটা আমি আনতে ভুলে গেছি, বাড়িতে রয়ে গেছে। খুব ভুল হয়ে গেছে। আজকের মত ছেড়ে দিন, প্লিজ", অনেকক্ষণ ধরে বরুণ নিজেকে প্রস্তুত করেছে অফিস ঘরের এই বাধা পেরোনোর জন্য। বেড নম্বরটা জানতে পারায় সুবিধাই হয়ে গেল। তাই বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই "মিথ্যে" বলে দিল বরুণ।

বেশ কটমট করে তাকালেন মহিলা, "কি বলছেন?ভিজিটিং কার্ড ছাড়া দেখা করা যাবে না। আপনি রোগীর মা-বাবা অথবা পরিবারের অন্য কোনও লোককে নিয়ে আসুন। এভাবে অজানা লোককে একলা কারও সাথে দেখা করতে দিতে পারিনা। আপনি আসতে পারেন।"

"দিদি, আমি গতকালও এসেছি। আমি ওর দাদা, বরুণ। একবার দেখা করতে দিন। আমি নিতান্ত বিপদের মধ্যে পড়েছি, তাই অনুরোধ করছি। নাহলে আপনাকে এভাবে কেন বিব্রত করব বলুন? আমার ভুল হয়ে গেছে। প্লিস, একটু দেখুন।" বরুণ একেবারে সাবলীল ভাবে "সাজানো" কথাগুলো একের পর এক বলে যাচ্ছিল। এক মুহূর্তের জন্যেও দ্বিধা করেনি, বরং সেই মহিলার চোখের ওপর চোখ রেখে কথা বলেছে নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ করার জন্য।

কিছুক্ষণ বরুণের চাহনির দিকে চেয়ে থাকার পর তিনি হার মানলেন বরুণের "স্বাভাবিক অনুনয়ের" কাছে। আসলে হসপিটালে রোগীদের সাথে দেখা করতে আসা আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে এই রকম ভুল অনেক সময়ই হয়ে থাকে। নিয়ম অনুযায়ী, এদের কাউকেই দেখা করতে দেওয়া উচিত নয়। কিন্তু উপরের ঘরগুলোতে যারা শুশ্রূষা করাতে এসেছে, তারা তো মানুষ, সোনারূপো তো আর নয়! তাই অনেক সময়ই মানবিকতার কাছে নিয়মের কাঠিন্যকে হার মানতে হয়ই।

"দিদি, অনুরোধ করছি। প্লিস যেতে দিন। আমি কালকেই ভিজিটিং কার্ড জমা দেব"

"ঠিক আছে, চলে যান। আজকের মত ছেড়ে দিলাম। উপরে কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবেন ভিজিটিং কার্ড নীচে জমা দেওয়া আছে। কাল অবশ্যই নিয়ে আসবেন, নইলে ঢুকতে দেওয়া হবে না"
বরুণ কথা শোনার পরই ধন্যবাদ জানিয়ে সোজা হাঁটা দিল বামদিক দিয়ে ঘুরে যাওয়া লবির দিকে। একটা সিঁড়ি সোজা উঠে গেছে ওপরের দিকে। কয়েকজন লোকের সামান্য আনাগোনা কিন্তু আপাতত বেশ কম লোক আশেপাশে। একটু থেমে বরুণ চারপাশ দেখে নিল ভাল করে, যাতে কোনও বাধা না ঘটে পরের দিকে। এরপর সিঁড়ি ভেঙে উঠে এগোতে থাকল সেই ঘরটার দিকে, যেখানে "সে" আছে। আর দূরত্ব কমে আসার সাথে সাথেই এক লহমায় বরুণের চোখের সামনে ভেসে আসছিল নানান মুহূর্ত। একবার ঘড়িটা দেখে নিল, "এখনও ওর মা বাবার আসতে অনেকটা সময় আছে..."

**** এক মাস আগের এক সপ্তাহ ****

"আমায় জানালার ধারে বসতে দেবে?"

অনেকক্ষণ দাঁড়ানোর পর, বেশ একঝাক লোক নেমে যেতেই, বরুণ বেশ খুশি মনে জানালার পাশে একটা বসার জায়গা পেয়ে গেল। ফুরফুরে হাওয়া যখন একরাশ প্রশান্তি নিয়ে তার জামা বেয়ে পৌঁছে যাচ্ছিল মনের খুব কাছাকাছি, ঠিক তখনই কথাটা কানে এলো পাশের থেকে।

ভিড় বাস তখন সল্টলেকের কলেজ মোড়ের কাছে জ্যামে দাঁড়িয়ে। কোলকাতায় শীতের শুরুর দিকের এই সময়টাতে, সাধারণত সকালের দিকটায় বেশ শিরশিরে শীত লাগলেও, বেলা বাড়ার সাথে গরমে গলদঘর্ম হবার মত অবস্থা হয়। সেক্টর ফাইভ যদি কোলকাতার তথ্যপ্রযুক্তি কেন্দ্র হয়, তাহলে কলেজ মোড় হল বিভিন্ন দেশী-বিদেশী সংস্থার ও কলেজের পীঠস্থান। তাই এই চত্বরের রাস্তা ঘড়ির কাঁটার মত দিবারাত্র সচল নানান ধরনের কর্মব্যস্ত মানুষের আনাগোনায়। শহরের নানা প্রান্ত থেকে বিভিন্ন রুটের বাস নামিয়ে দিয়ে যাচ্ছে একের পর এক মানুষের ঢল। কেউ চাকরি প্রার্থী, কেউ নেহাত খোঁজ নিতে এসেছে, কারও ইন্টারভিউ, কেউ বিলি করতে এসেছে সংস্থার কাগজ, কেউ এসেছে দূর দূরান্ত থেকে পরীক্ষা দিতে। আর এছাড়া আছে নিত্য চাকুরীজীবীদের সমাগম।

তাই বাসের ভিড়টাও এতটাই মারাত্মক হয়, যে প্রায় নাভিশ্বাস ওঠার মত অবস্থা হয়। গায়ের ওপর হেলে আসা গা, পাশাপাশি ঘামের থেকে আসা অস্বস্তি, কোনও "অপ্রীতিকর" অবস্থা এড়াতে লেডিস সিটের দিকে না দাঁড়ানো, গতিশীল বাসের শেষ পাদানিতে প্রাণপণ নিজেকে ধরে রাখার চেষ্টা, অথবা কোনও রকমে বাসের একটা সিট যোগাড় করা (এমনকি বল প্রয়োগ সহযোগে)- এগুলো নিত্যদিনের সঙ্গী যেকোনো বাসে। এটাই ব্যস্ত শহরে প্রতিদিনের "মেনে নেওয়া"।

চেন্নাই থেকে কোলকাতা ফেরার পর, বরুণের নতুন অফিসের ঠিকানা হয়েছে রাজারহাটের কাছে তথ্য প্রযুক্তি পার্কে। তাই প্রতিদিন তার নিত্য যাতায়াতে কলেজ মোড় অবশ্যই ছুঁয়ে যেতে হয়। প্রায় ৪ বছর বাদে কোলকাতায় ফিরেছে, আর এই অফিসটাও একেবারে নতুন। এমনিতে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের ছেলে, কিন্তু কর্মসূত্রে ঘুরতে হয়েছে দেশ ও বিদেশের নানা প্রান্তে। আপাতত উত্তর কোলকাতায় একটা মেস যোগাড় হয়েছে, আর সেখান থেকেই প্রতিদিনের যাতায়াত।

মুখ ফিরিয়ে লক্ষ্য করল, একটা ছোট্ট বাচ্চা মেয়ে, মাথায় সুন্দর করে একটা রমালের মত স্কার্ফ বাঁধা। একগাল হেসে আবার বলল, "আমায় জানলার দিকটা দেবে? আমার খুব ভাল লাগে রাস্তা দেখতে..." মিষ্টি মুখে একরাশ ইচ্ছে তার গালের ওপর টোল ফেলছিল। বয়স একেবারেই বেশি না, এক্কেবারে ছটফটে দুষ্টুর মত গোল চোখ।

"হ্যাঁ অবশ্যই", এইটুকু খুদের অনুরোধ ফেলা প্রায় অসম্ভব ছিল বরুণের। এক কথায় পরম যত্নে তাঁকে বসিয়ে দিল জানলার ধারে। বাসের ঝাঁকুনি বেশি ছিল বলে, যাতে সে দুষ্টুমি না করে, তাই খুব কাছ থেকে ধরে রাখল হাতের বাঁধনে। কিন্তু বরুণের চোখ খুঁজতে লাগল তার "মা বাবা"কে। যাত্রীদের মধ্যে থেকে অনুমান করার চেষ্টা করল সামঞ্জস্যপূর্ণ কেউ যে ওর সঙ্গে এই বাসে থাকতে পারে।

"তুমি কোথায় যাচ্ছ? এই বাসে করে শেষ কোথায় যাওয়া যায়?" ছোট্ট মেয়েটা খুব আগ্রহের সাথে জিজ্ঞেস করল। সাধারণত এমন ভিড় বাসে কোনও অচেনা অতিথির থেকে এমন সাবলীল প্রশ্ন ভাবাই যায়না। সমবয়সী কেউ হলে তবু কথা ছিল। কিন্তু এই খুদের উৎসাহ বেশ চোখে পড়ার মত। মাঝে মাঝে হাত নাড়াচ্ছিল রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনের দিকে, কখনও বেশ আশ্চর্যের সাথে দেখছিল পিছনের দিকে ছুটতে থাকা শহরের উঁচু তলার বাড়ি আর তার মাঝে সবুজের আহ্বান নিয়ে জেগে থাকা গাছের সারি; কখনও তা ছিল একলা ঢেউ খেয়ে নেমে যাওয়া ব্রিজের হাতছানি, কখনও বা রঙের বাহারে রাস্তার দুই ধারে সেজে থাকা বিশাল আকারের বাক্যময় বিজ্ঞাপন।

বরুণ উত্তরের কথা না ভেবে, আরও বেশি উৎসুক হয়ে পড়ল বাচ্চাটার মা-বাবা অথবা অভিভাবক কাউকে নির্দিষ্ট করে খুঁজে বার করার জন্য। নেহাত বাধ্য হয়েই জিজ্ঞেস করল, "এই মেয়ে, তোমার সাথে কে উঠেছে বাসে?"

বেশ খানিকক্ষণ মিটমিট করে তাকিয়ে থাকার পর বলল, "ওই যে ওই দিকে..." পিছনের সারিতে বসে থাকা এক ভদ্রলোককে চিনিয়ে দিল। বরুণ খানিকটা আশ্বস্ত হয়ে আবার নিজের চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেল। কোলকাতায় যোগ দেবার পর থেকেই কাজের চাপে নাভিশ্বাস উঠছে। গত রাতে প্রায় দেড়টা নাগাদ অফিসের গাড়ি মেসে পৌঁছে দিয়ে গেছে। তার ওপর সকাল সকাল অফিসের থেকে ঘন ঘন ফোন। ভিড় ঠেলে আসার সময় এমনি মেজাজ ঠিক ছিল না। তার মাঝখানে এমন দুষ্টু মিষ্টি একজনের সাথে দেখা। তাই কথা বা গল্প করার ইচ্ছে অনেক থাকলেও, খুব একটা ভাব জমে উঠল না। বরুণ কোনও প্রশ্নের উত্তর দেয়নি, শুধু একটু বকে দিয়েছিল, "চুপটি করে বস, জানালার বাইরে একদম হাত নয়।" হয়তও অতটা গুরুত্ব দেয়নি তার সাবলীল কৌতূহলকে, বরং ব্যস্ত থেকেছে বাকি সারাটা দিন কিভাবে গতকালের ফেলে যাওয়া কাজগুলো মেটাবে- এই ভাবনাগুলো নিয়ে।

কলেজ মোড় ছাড়িয়ে বাস বেশ কয়েক স্টপেজ পর থেকে তখন নিউটাউনের রাস্তা ধরে নিয়েছে। তার অভিভাবকের দিকে তাকিয়ে উঠে যাবার আগে বরুণ বলল, "আমি রাজারহাট, নিউ টাউনে নেমে গেলে আপনি এখানে এসে বসুন। নাহলে দুষ্টুমি করবে।"

**** আজকের দিনে ***

মুখ বাড়িয়ে একবার দেখে নিল, কেউ আসছে কিনা। চিন্তা তখন ঘামের মত জল হয়ে নেমে আসছে বরুণের পিঠ বেয়ে। ছোট্ট মেয়েটা তখন চুপ করে মাথা রেখেছে "বন্ধুর" কাঁধের ওপর। মাথায় তখনও স্কার্ফ জড়ানো। ছোট্ট দুটো হাতে জড়িয়ে রেখেছে বরুণের গলা, আর পরম বিশ্বাসে আঁকড়ে ধরে রেখেছে তার বুক। বরুণ ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আরেকবার উঁকি মেরে দেখল। একজন নার্স কথা বলতে বলত চলে গেলেন পিছন ফিরে। বরুণের সুঠাম হাতের কোলে ছোট্ট রূপসা তখন আনন্দে আটখানা, তবু উৎসাহ চেপে রেখেছে চুপটি করে।

"তুই এনেছিস তো?"

বরুণ খুব আদর করে ওর গাল মুছিয়ে দিল, "বললাম তো, সেই জন্যেই এসেছি এখানে...একদম কথা নয় এখন।"

"জানিস, দিদিমনি যদি মা বাবাকে বলে দেয়?আমি খুব বকা খাব..."

"আমাকে বিশ্বাস করিস তো? কিছু হবে না, আমি আছি তো?", বরুণের এই কথাটার পর রূপসা চোখ বুজে আরও চেপে ধরল বরুণের কাঁধ, আর মাথা রেখে শুয়ে গেল।

একটু নির্জন হয়ে যেতেই, সকলের নজর এড়িয়ে বরুণ পা টিপে টিপে এগোতে থাকল করিডোর দিয়ে। শেষের দিকটাকে একটু জোরে পা চালিয়ে পৌঁছে গেল "ফায়ার এগজিট" দরজার দিকে। বিগত কয়েকবার লুকিয়ে যখন এসেছে হসপিটালে তখন লক্ষ্য করেছে, এই ফায়ার এগজিটের দিকটায় কোনও সিকিউরিটি গার্ড থাকে না। এই সময় অধিকাংশ স্টাফের শিফট পরিবর্তন হয়, তাই "নজর" করার লোকের সংখ্যা কম। এখানের থেকে একটা অন্য সিঁড়ি নেমে গেছে বাড়ির পিছনের দিকে। কয়েকজন রোগীর আত্মীয় ইতিমধ্যেই উপরে আসছিল। তদের দেখে প্রথমে একটু থতমত খেলেও, পরে তাদের মধ্যে দিয়ে পাশ কাটিয়ে সটান চলে গেল দরজার দিকে। দরজাটা আস্তে আস্তে ভেজিয়ে দিয়ে কোলে আরেকটু শক্ত করে ধরে রাখল রূপসাকে, আর তারপর দ্রুত পায়ে নেমে এলো একেবারে নীচের তলায়। বাকি শুধু আরেকটা দরজা।

ধীরে ধীরে রূপসাকে মাটিতে নামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, "এই টুকু হেঁটে যেতে পারবি তো? নাকি ধরতে হবে?"

রূপসা কোনও কথা বলেনি, শুধু মাথা নাড়াল সম্মতি জানিয়ে। আর তারপর শক্ত করে ধরে রাখল বরুণের হাত। খুব করুণ ভাবে আঁকড়ে ধরল আঙুলগুলো। বরুণ খুব আশ্চর্য পরিবর্তন অনুভব করল রূপসার মধ্যে। রূপসার স্পর্শে বুঝতে পারছিল সে যে ছোট্ট মেয়েটা সত্যিই বিশ্বাস করেছিল "সে আসবে তার জন্যে"।

***** বেশ কয়েক সপ্তাহ আগে এক কাজের দিনে ****

আবার দেখা বাসে। তবে এবারে দেখা হল কলেজ মোড়ের অনেক আগে। সাধারণত যে বাসে করে বরুণের নিত্য যাতায়াত সেটা শ্যামবাজার ঘুরে বিধান নগর হয়ে চলে যায় সল্টলেকের ভেতরে। তাই সিট পাওয়ার জন্য, বরুণ মেস থেকে কিছুটা উল্টো দিকের রাস্তায় হেঁটে শ্যামবাজার থেকেই বাসটা ধরতে বেশি পছন্দ করে। খানিকক্ষণ বসে থাকার পরই লক্ষ্য করল এক ভদ্রলোককে, যাকে চেনা চেনা লাগছিল। "হ্যাঁ, সেই দুষ্টু মেয়েটার বাবা তো!" তারপরই ইতিউতি এদিক সেদিক দেখার পর লক্ষ্য করল সেই ছোট্ট মেয়েটি তার মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে। মুখের ভাবখানা এরকম যে ,হাসছে না রাগ করে বসে আছে, তা বোঝার উপায় নেই। বরুণ দু একবার তার মুখের দিকে তাকালও, হয়তও মনে মনে তার নির্মল মুখ খানা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করল। অন্যদিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর, আর পারল না। "একজন কথা বলার তো লোক পাওয়া গেছে। সারাটা রাস্তা ভালই হবে।"- এই ভেবে উঠে পরে মেয়েটার পাশের সিটে বসে পড়ল।

একটু সঙ্কোচ বোধ করছিল কিভাবে কথা শুরু করবে, ঠিক তখনই সেই মিটমিট চোখে সে বলে উঠল, "কিগো, কেমন আছো?"

বরুণ মনে মনে ভাবল, "বাবা, মেয়েটার ভারি পাকা পাকা কথা তো? বয়সে দেখতে এইরকম, কিন্তু জ্ঞান পুরো টনটনে। ঠিক চিনতে পেরেছে। হয়তও মনে রেখেছে সেই জানালার ধারে বসতে দেবার জন্য। নাহলে এমন তো রাস্তা ঘাটে কত কাকু-দাদা-দিদিরা হয়তও ওর গাল টিপে আদর করে। আমাকে মনে রাখার মত তেমন কিছু ঘটেনি!"

"কিরে? তুই কেমন আছিস?" বলেই বরুণ আবার বেশ অভিভাবকের মত হাতের আড়ালে চেপে রাখল মেয়েটাকে, যাতে পড়ে না যায়। হাওয়ার টানে, মেয়েটার মাথার সেই লালরঙা স্কার্ফ ফুরফুর করে উড়ছিল। জানালা দিয়ে সকালের ঠাণ্ডা হাওয়া হুহু করে ঢুকছে দেখে, জানালার কাঁচটা নামিয়ে দিল।
জানালা বন্ধ হয়ে যেতে পারে এই ভেবে তক্ষুনি বলে উঠল, "নানা, জানলা বন্ধ করো না!"

"এই দাঁড়া, ঠাণ্ডা লেগে যাবে। কাঁচের ভেতর দিয়েও তো সব দেখা যায়"

"তাহলে ঠিক আছে। তা তুমি রোজ এই ভাবেই স্কুল যাও?"

"রোজ মানে? আবার কবে দেখেছিস আমায়?"

"কেন, রোজই তো দেখি এই বাসে। "

বরুণ বুঝতে পারল এই খুদেও তার নিত্যদিনের সহযাত্রী। বরুণকে হয়তও অনেকবার লক্ষ্য করেছে এই বাসে, তাই চেনা রয়ে গেছে।

"হ্যাঁ, আমার একটা বড় স্কুল আছে। সেখানে শুধু বড়রা পড়াশোনা করে। এই দ্যাখ, আমার ইয়াব্বরড় ব্যাগ। "
"এতে মোটামোটা বই আছে?"

"হ্যাঁ আছে। আমার একটুও পড়তে ভাল লাগে না, জানিস। কেউ ছুটি দেয়না আমায়..." বরুণ একটু বেশ মজা করার মেজাজে চলে এলো।

"তোকেও ছুটি দেয়না?" বলেই হাততালি দিয়ে উঠল।

"আমাকে তুই বলছিস কেন?", বরুণ বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল তার হঠাৎ "তুমি থেকে তুই তে" অবতীর্ণ হওয়া দেখে।

"আমাকেও তো তুই বলেই ডাকছিস...আমি বারণ করেছি?" বরুণ বুঝতে পারল এই পাকা পাকা কথার কারণ, তাই আর কোনও "বাগ বিতণ্ডা" বাড়াল না।

"তোর নাম কি রে? কোথায় যাস রোজ?"

"আমি রূপসা... রূপসা মল্লিক। আমিও তোর মত স্কুলে পড়তাম। কিন্তু কি জানি, বাবা হঠাৎ এখানে এক অন্য স্কুলে ভর্তি করেছে...সেখানে রোজ আমায়..."

বরুণ তার কথা শেষ হবার আগেই বিজ্ঞের মত বলল, "ওরে, সবারই একই দুঃখ। রোজ রোজ সকালে ওঠো রে, দাঁত মাজও রে, ব্যাগ গোছাও রে..." বরুণ মনে মনে বুঝতে পারছিল যে এই "বড়" বয়সেও রুটিনের একেবারেই পরিবর্তন হয়নি। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে গেলেও, সত্যি বলতে অফিসটাও তার কাছে একটা "বড়দের স্কুল" হয়ে উঠেছে। পদে পদে উঠতে বসতে জবাবদিহি, হাজার রকমের কাজ, প্রোজেক্টের চাপ, আর সর্বোপরি সারাদিন কাজ করে সামলে দেবার পরও দিনের শেষে বসের সাথে মীটিং-এ উত্তাল ঝাড় খাওয়া (যা নেহাতই সব পড়া করে আসার পরও বদ মাস্টারমশাইের খপ্পরে পড়ে ক্লাসের বাইরে কান ধরে উঠবস করারই সামিল)- এইসবি বোঝায় যে বরুণ যেন এখনও স্কুলের গণ্ডি পেরোতেই পারেনি। তাই মনের কোনও একটা কোণে কথাগুলো যেন মিলে যাচ্ছিল সেই রূপসার সাথে।

"আমি বরুণ। আমার স্কুল তোর আগের রাস্তায় পড়ে।"

"বাহ, তোর স্কুল তো দেখতে পাই, কিন্তু আমার স্কুল যদি দেখতে চাস, আমাকে বলিস। দুষ্টু দিদিমণিরা কেমন হয় দেখাব তোকে। আমি কিছু না করলেও বলে চুপ করে বসতে। খালি বকে, খালি বকে। আমার একটুও ভাল লাগেনা জানিস।"

"আচ্ছা, স্কুলের কথা বাদ দে। আমার একটুও ভাল লাগেনা এসব কথা বলতে। তুই আঁকিস?"
"হ্যাঁ", বেশ গোল গোল চোখ করে ঘাড় দুলিয়ে বলে উঠল। "আমি আঁকি জাহাজ, রাস্তা, পাখি, আরও কত কিছু। সারাদিন রাস্তায় যা দেখি, সব একে ফেলি। "

"আমাকেও একদিন একে ফেলিস।"

"একেছি তো!"

বরুণ আকাশ থেকে পড়ল, "আমাকে এঁকে ফেলেছিস? এই তো আমাদের দ্বিতীয় বার দেখা। তাতে..." বিশ্বাস হচ্ছিল না যে সত্যিই এঁকেছে। "কই দেখা দেখি..."

অমনি চটপট রূপসা তার ছোট্ট নিল ব্যাগ থেকে একটা খাতা বার করল। তাতে অজস্র ছবি আর আঁকি বুকি।অনেক ক্ষণ এদিক সেদিক পাতা উল্টানোর পর একটা পাতা ধরে রাখল আমার কোলে, "এই দ্যাখ"।প্রায় কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং মত একটা ছবি, যেটা দেখে কিছুতেই বোঝার উপায় ছিল না যে সেটা "মানুষ"; যদি না ছবির নীচে কচি হাতে বেশ গোটা গোটা করে লেখা থাকত সেই কথাটা। বরুণ বুঝল, "সত্যিই তো, আমারই ছবি। মানুষের ছবি। সারাদিন কাজের পর যখন রোজ বাড়ি ফেরে কেউ, তার অবস্থা অনেকটা এরকমই ছন্নছাড়া হয়ে থাকে।"

তবে শুধু এই কথা নয়, "কি করতে ভালবাসিস, কয়টা কবিতা জানিস, হাট্টীমাটিম টিম...এবং আরও অনেক কিছু"- একবার যখন দুটো ভিন-বয়সের অভিন্ন হৃদয় মানুষ তাদের বন্ধুত্ব খুঁজে নিচ্ছিল, তখন দেখতে দেখতে বরুণ খেয়ালও করেনি যে কখন বাস পৌঁছে গেছে নিউটাউন মোড়ে। "এই শোন না, আমায় যেতে হবে...পরদিন দেখা হলে চকোলেট দেব।" নামার আগে তার বাবার দিকে মুচকি হেসে বিদায় জানাল।

বাসটা বেরিয়ে যেতেই, বরুণ কেমন যেন একটা "ভাল লাগা" অনুভব করতে থাকল। অফিসের গেট থেকে কিউবিকল পর্যন্ত যাত্রাটা প্রায় মিনিট কুড়ি লাগে- বিশাল অফিস চত্বর। কিন্তু এই সারাটা রাস্তা, সিকিউরিটি চেক, এলিভেটর, লম্বা করিডোর- এর সমস্ত কিছুটাই বরুণের মন জুড়ে রইল রূপসার সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত। মনে মনে ভাবল, "কই, অনেকদিন তো এভাবে মন খুলে কথা বলেনি সে। কথা তো দূরের কথা, ভালভাবে হাসেও নি। অফিসের টাইমলাইন, পাই চার্ট, মিটিং, কনফারেন্স এসবের মাঝে পড়ে বরুণ কবে যেন হারিয়ে গেছিল। সেই ছোট্ট বরুণ। আজ যেন কোনও ভাবে তার দেখা পেয়েছে।"

সারাটা দিন বেশ ফুরফুরে থেকেছে, কম কথা বললেও নিজের চেয়ারে বসে পেন্সিল ঘোরাতে ঘোরাতে আনমনে হেসেছে নিজের ছোটবেলার কথাগুলো মনে করে।কখনও প্রিন্টার এর ফেলে দেওয়া কাগজে আঁকিবুঁকি কেটেছে , কখনও মুখ উঁচিয়ে দেখতে চেষ্টা করেছে তার এই স্কুলের মত অফিসের বাকি "ছাত্রছাত্রীদের" অবস্থা। মনে মনে ভেবেছে "আবার যেন দেখা হয়।" পাছে ভুলে যায়, তাই ক্যাফে থেকে আগেভাগে চকোলেট কিনে ব্যাগে জমিয়ে রেখেছে। মোটামুটি একটা বিশেষ সময়ের মধ্যে বাস ধরলেই তার দেখা পাওয়া যেতে পারে- এটা বুঝতে পেরেছে বরুণ।

**** আজকের দিনে ****

"কোথায় আছে রে সেটা?"

"দাঁড়া না, আমি দেখাবো। এই খানে চুপটি করে থাক। আমি একটু দেখে আসি কেউ আছে কিনা।" দরজার বাইরে একটা সরু পথ চলে গেছে হসপিটালের পিছনে সুন্দর বাগানের দিকে। এই বাগানটা হসপিটালের পশ্চিম প্রান্তে- একটু বাঁকা ভাবে সাজানো একটা ফুলের নার্সারি। লোহার গ্রিলের বাঁধনে ধরা বাগানের সবুজ ভাস্কর্য। বরুণ এই জায়াগটাকেই বেছে নিয়েছে "নিরাপদ" হিসাবে। সকালের মালিরা বাগানের পরিচর্যা করে চলে যাবার পর সারাদিন এই জায়গাটা ফাঁকাই থাকে। আসলে হসপিটালের এই দিকটা এমনিতে সাধারণের প্রবেশের জন্য নয়। দুদিন আগেই বরুণ এখানের কেয়ার টেকারের কাছে গল্পের ছলে কথায় কথায় জেনে নিয়েছে এইসব কথা।

লোহার গ্রিলটা কোমরের সমান। তাই পেরোতে কোনও অসুবিধার হওয়ার কথা নয়। খুব সন্তর্পণে ব্যাগ গলিয়ে দিল বাগানের ভেতর। তারপর টপকে গেল লোহার রেলিং। এরপর রূপসাকে কোলে তুলে কাছে টেনে নিল, নিয়ে এলো বাগানের ভেতর।

থাকতে না পেরে রূপসা জিজ্ঞেস করেই ফেলল পরম উৎসাহে "এই ব্যাগে করে এনেছিস?"
বরুণ হেসে বলল, "আয় আমার সাথে"

***** শেষ যেদিন দেখা হয়েছিল ****

এই নিয়ে বেশ অনেকবারই দেখা হয়েছে দুজনের।কখনও বাসের পিছনের সিটে হোহো করে হাসাহাসি, নাহলে কখনও "কি খেয়েছিস, কি এঁকেছিস, স্কুলের বদমাশ বন্ধু, টিফিনের গল্প, মোটা গোঁফওয়ালা বেড়াল, নতুন কেনা পুতুলের বিয়ে এবং আরও অত কিছু" উঠে এসেছে দুজনের কথোপকথনে। হয়তও কিছু কথা হয়েছে, কিছু কথা বাকি থেকে পরের দিনের দেখা হওয়া পর্যন্ত। কিন্তু বরুণও জানত সত্যিই আর কতদিন দেখা হবে ওর সাথে। প্রথম দু এক দিন অতটা লক্ষ্য করেনি, কিন্তু আস্তে আস্তে সন্দেহ করেছে ওর কথাবার্তা শুনে, পরে অনেকটা নিশ্চিত হয়েছে ওর বাবার সাথে কথা বলার পর।

মাঝবয়সী একজন ভদ্রলোক, মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি আর দুশ্চিন্তার জ্বরা তাঁর দেহের গঠনে স্পষ্ট। এমনিতে বেশ কয়েকবার সৌজন্য বিনিময় হয়েছে দুজনের মধ্যে, কিন্তু সেইদিন তিনি যেন একটু বেশি কথা বলতে চাইলেন। পাশের সিটেই বসেছিলেন যখন বলে উঠলেন, "আচ্ছা সব বাচ্চারাই কি ওর মত হাসি খুশি হয়, নাকি ও যেন একটু বেশিই আনন্দে থাকে?" জানালার দিকে একটু তাকিয়ে থেকে, মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞাসু হয়ে আবার বললেন, "জানও, আমি নিজে ঠিক জানিনা ওকে কতটা ভালবাসতে পেরেছি, কিন্তু আমার শুধু চিন্তা হয় ওর মাকে নিয়ে। দিনে দিনে শেষ হয়ে যাচ্ছে দুটো মানুষ আমার চোখের সামনে।নিয়তি কেমন স্বার্থপর তাই না? আমার রূপসার ওপর মাঝে মাঝে খুব রাগ হয়। কেন ও এতো ভাল হতে গেল? কেন এতো কষ্ট নিজের কাঁধে নিতে গেল? আমরা তো কোনও দোষ করিনি, তবু যেন খামতি রয়ে গেল জানও।আমি ওকে বলেছি, কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতে 'স্কুলে যাচ্ছি'। নাহলে সবাই কুড়ে কুড়ে প্রশ্ন করে, কি হয়েছে, কেন হয়েছে।কেউ সহানুভূতি জানায়, কেউ মতামত দেয়। আমার একটুও ভাল লাগে না। কেমন যেন লজ্জা লাগে।" একটু থেমে বললেন, "ওর সামনেও এসব আলোচনা এড়াতে চাই। ওকে বুঝতে দিতে চাইনা......তাই"

রূপসা তখন আগের দিকের কোনও এক দিদির সাথে গল্পে মত্ত; শুধু বরুণ নয়, অনেকের জন্যই মেয়েটা খুব আপনজন ছিল।

বরুণ সান্ত্বনা দিয়ে বলল, "এভাবে ভাবলে চলবে না। আপনাকে শক্ত হতে হবে। নিজেকে সংযত রাখতে হবে।" কিন্তু বরুণের কথা শেষ হতে না হতেই কিছুটা অভিমানের সুরে বললেন, "ভেঙে পড়লে চলবে না, এই বলতে যাচ্ছিলে তাইতো? সত্যি বলতে আর কিছু বাকি নেই, ঘরটাই যখন ভেঙে যেতে চলেছে।" বরুণের কাছে কোনও আশ্বাসের কথা ছিল না এরপর।

চশমাটা খুলে রেখে আর্দ্র চোখে ভদ্রলোক বললেন, "বয়স আট হলেও, জ্ঞানত আমার মনে হয়, ও সব কিছু বোঝে। কিন্তু ভীষণ হিসেবি। তাই হয়তও জীবনের সমস্ত আনন্দ, দেখা, উচ্ছ্বাস সবকিছু ওর ছোট্ট পরিসরের মধ্যে একসাথে নিয়ে নিতে চায়। সবটুকু পেতে চায়, কিছু বাকি রাখতে চায় না।" বরুণ বুঝতে পারছিল, রূপসার এই আনন্দে থাকার অন্তর্নিহিত সত্য। সময় যেন ফুরিয়ে আসছে, তাই হয়তও ওর কাছে পৃথিবীটা আমাদের থেকে একটু অন্য রকম, সব সময় রঙে ছটায় ভরপুর।

কথায় কথায় বরুণ জানতে পারল, টাটা ক্যানসার হসপিটালে রক্তজনিত কোনও সমস্যার চিকিৎসা চলছে। বরুণের অফিসের থেকে আরও কয়েকটা স্টপেজ আগে। রূপসা তাই মাঝে মাঝেই বলতও, "তোর স্কুল দেখা হল, একদিন আমার স্কুলেও আসিস"। এমনিতে রোগ দুরারোগ্য নাহলেও, শিশুদের ক্ষেত্রে জীবন সংশয় আছে। আগামী সপ্তাহে একটু লম্বা সময়ের জন্য ভর্তি হতে চলেছে সেখানে। এইকয়দিন নানা রকম রিপোর্ট, টেস্ট এইসব চলছিল; তাই এই ঘন ঘন যাতায়াত।

নিউটাউন মোড়ে নামা আগে রূপসা একটু ঈশারা করল বরুণের দিকে। বরুণ একটু আশ্চর্য হয়ে দেখল ওর দিকে, মনে হয় কিছু বলতে চাইছে। কাছে যেতেই বরুণের কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে দিল কিছু কথা। বরুণ প্রথমে কথাগুলো শুনে একটু অবাক হয়, নিশ্চিত হবার জন্য তাকায় রূপসার মুখে। কিন্তু ওর হাসি দেখে বুঝতে পারে, "এই আবদার ফেলার নয়।"

**** আজকের দিনে ****

বাসে শেষ দেখ হওয়ার রেশটা বরুণের মনে দাগ কেটে গেছিল। এমন নয় যে "এইটাই শেষ দেখা"। কিন্তু তবু তিলে তিলে একটা ছোট্ট মেয়ের শেষ হয়ে যাওয়ার কথা মনে পড়লেই কেমন যেন একটু শিউরে উঠত। প্রথম কয়েকদিন অফিসে খুব একটা কথা বলেনি। বন্ধুরা অনেকে জিজ্ঞেস করলেও সদুত্তর তারা পায়নি বরুণের থেকে। আসলে কোথাও কোথাও বরুণের মনের অনেকটা অংশ জুড়েও ছিল রূপসা, সেই দরজা দিয়ে আসা রোদের গুঁড়োর মত। হাজার আটকালেও সেই আলো কি রোখা যায়? বলতে গেলে রূপসা এমন একজন ছিল, যার সাথে যেমন খুশি কথা বলা যেত।বরুণ তো ওর মধ্যে নিজের ছোটবেলার দিনগুলো খুঁজে পেয়েছে,ওর আঙুলের স্পর্শে পেয়েছে এক অসামঞ্জস্য বন্ধুত্বের ভালবাসা। বাসে করে যাবার সময় অনেকবার ভুল করে রেখেছে সিট, রূপসার জন্য, কখনও আনমনে খুঁজেছে ওকে; যদিও পরে ভ্রম কেটেছে এই ভেবে, "ও! এই সপ্তাহ থেকে তো ও অ্যাডমিট হয়েছে"। ব্যাগের মধ্যে পরে থাকা বাকি চকোলেট গুলো রাস্তার কয়েকটা বাচ্চাকে দিয়ে দেবার পরও, একটা বাঁচিয়ে রেখে দিয়েছে ওর জন্য, পরম বিশ্বাসে, "ও তো আবার সেরে উঠবে, স্বাভাবিক হয়ে যাবে"।

প্রথমে ভেবেছিল, আবদার এভাবে রাখা সম্ভব নয়। কিন্তু যতই মনের "ফাঁকা" অংশটা বেড়েছে, বরুণ ততই বাধ্য হয়েছে সেই আবদারের কাছে বশ্যতা স্বীকার করতে। বারবার ক্যালেন্ডার দেখেছে এক একটা করে দিন চলে যাবার সময়। আর শেষে এসে পৌঁছেছে আজকের এই সময়ে। বরুণ জানে, এইরকম একটা কাজ শুধু বিপজ্জনক নয়, কিন্তু অপরাধও বটে। পরিবারের সম্মতি ছাড়া, এভাবে কাউকে রুম থেকে বের করে আনা, সবার নজরের আড়ালে রূপসার বিপত্তিও ঘটাতে পারে। কিন্তু মেয়েটা যে "আবদার" করেছিল, "আবদার করেছিল তার ইচ্ছে মেটাবার"। সেটা ফেলনা হয়ে যাবে কি করে?

বাগানের এই অংশে একটা বেশ সুন্দর ডালিয়া ফুলের গাছ আছে।নানা রকমের ফুলের সারি, আর তার মাঝে একটা ছোট্ট বেঞ্চ। পশ্চিমের সূর্য তখন, অস্ত পথগামী। আর তার লালচে আভা এসে পড়ছে দুটো মানুষের মুখে- দুই অভিন্ন হৃদয় বন্ধুর জীবনে। রূপসার একটু ধকল গেছে এই নিয়ে আসার মাঝে। তাই বরুণের হাতের কাছে মাথা রেখে একটু ঝিমিয়ে ছিল। কড়া ওষুধের প্রভাব এতো সহজে যায়না। কিন্তু বরুণ একটু নাড়া দিয়ে বলল, "কিরে? দেখবি না?" মাথায় স্কার্ফ জড়ানো মেয়েটা অমনি বেশ চটপট সোজা হয়ে বসল, আর পরম আনন্দে বলল, "আমার জন্মদিনের গিফট দেখা তাহলে"
হয়তও এই জন্যেই অস্তগামী সূর্য সব চেয়ে রঙিন, দূর থেকে খসে যাওয়া তারা এতো সুন্দর, নিভে যাবার আগে প্রদীপের আভা তাই সব থেকে বেশি সমুজ্জ্বল। হয়তও রূপসাও তাই তিলেতিলে শেষ হয়ে যাবার সময়েও এতো হাসিখুশি, এতো আনন্দ করে অপেক্ষা করেছিল ওর জন্মদিনের উপহারের জন্য- যা কেউ ওর থেকে কেড়ে নিতে পারবে না।

"আমার জন্মদিন বাইশে, আসবি তো?" এই কথাটাই কানে কানে বলেছিল রূপসা বরুণকে। বরুণ অনেক ভেবেছে কিভাবে দেখা করা যায়, কি উপহার দেওয়া যায়।

ব্যাগের মধ্যে থেকে আস্তে আস্তে বার করল একটা বেশ বড় কাঁচের বয়েম- যার মুখের ওপর জালের আবরণ দেওয়া, আরে রেখে দিল রূপসার কোলে। কাঁচের সেই শিশিতে ধরা নানা রং বেরঙের প্রজাপতি যারা ছটফটিয়ে মরছে একটু মুক্তি পাবার জন্য। কোনটা হলুদ, কোনটা সবুজে, কোনটা বেশ সাতরঙা- প্রাণ খুলে ডানা মেলার জন্য আকুল। ধীরে ধীরে জালের মুখটা খুলে দিতেই, হাজারও রং পাখা মেলে দিল রূপসার আসে পাশে, আর ছোট্ট মিটমিট চোখ ভরে উঠল অনাবিল আনন্দে। হাততালি দিয়ে বিস্ময়ে দেখতে থাকল, নানা রঙের প্রজাপতি- উড়ে যাচ্ছে একের পর এক তার কোলে রাখা বয়েম থেকে।খিলখিলিয়ে উঠল ছোট্ট হাসিমুখ। কোনটাকে ছুঁতে চাইছে সে, কোনটা গায়ে এসে বসছে, কোনটা ঘুরে বেড়াচ্ছে তার আশেপাশে। ওর ছোট্ট আঙুল তখন প্রাণপণে স্পর্শ করে দেখছে মুক্তির স্বাদ।

বরুণ দেখেছে ছটফটে রূপসার দুহাত বাড়িয়ে আনন্দকে জড়িয়ে ধরা, দেখেছে ওর সূর্যস্নান, দেখেছে ওর মুক্তির চেষ্টা। ছোট্ট মেয়েটা যখন বেঞ্চ থেকে উঠে একটু একটু পায়ে এগিয়ে গেছে তার হাত বাড়িয়ে প্রজাপতির দিকে, বরুণের হাতটাও যেন আনমনে উঠেছে ওর দিকে তাকিয়ে, একবার ধরার জন্য। রূপসার জন্মদিনের উপহার যখন হয়ে গেছে বরুণের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।মুক্তি কেউ আটকাতে পারেনা, বরুণও পারবে না। বরুণও যেন রূপসার জায়গায় নিজেকে খুঁজে পেয়েছে; রূপসা যেমন একটু একটু করে চেষ্টা করছে জীবনকে করে ধরে রাখার জন্য, বরুণও আনমনে কোথাও যেন আঁকড়ে ধরতে চেয়েছে তার ছোট্ট বন্ধুকে।

এ যেন, শেষ হয়ে যাবার আগেও শেষ না হওয়া, পথের প্রান্তে পৌঁছেও আরেকটু পথ চলা, চলে যাবার আগেও আরেকবার ফিরে "দেখা"।

ধন্যবাদান্তে,
সম্পাদক-নবপত্রিকা

1 comment:

  1. "এ যেন, শেষ হয়ে যাবার আগেও শেষ না হওয়া, পথের প্রান্তে পৌঁছেও আরেকটু পথ চলা, চলে যাবার আগেও আরেকবার ফিরে "দেখা"।"

    ReplyDelete