বিগত বেশ কয়েক সপ্তাহে, বিভিন্ন সম্ভাবনা ও "যদি" নিয়ে কথা হয়েছে। আজও এমনই এক "যদি" কে টেনে আনব সবার সামনে। জীবন সম্ভাবনাময়, আর সেখানে কোন জিনিসটা রয়ে যাবে স্মৃতির
বলিরেখার মতো, আর কোন জিনিসটা চিরতরে মুছে যাবে বালির ওপর আদর করে লেখা নামের মতো, সেটা আমি, আপনি, তুমি বা তুই -এর কেউই জানে না। প্রতি মুহূর্তে আমরা আমাদের আগামীকে পাবার জন্য ছুটছি, আর প্রতি নিয়ত আমাদের সংসারের দেওয়ালে অজান্তে কেটে চলেছি হিসেবের অঙ্ক। এমন এক অঙ্ক, যার শেষ প্রান্তে বসে আছে আমাদের ইপ্সিত কিছু ইচ্ছে, আর সারাটা অঙ্ক জুড়ে আমরা শুধু সেই "ফলটুকু" মেলাবার চেষ্টা করে চলেছি।
বলিরেখার মতো, আর কোন জিনিসটা চিরতরে মুছে যাবে বালির ওপর আদর করে লেখা নামের মতো, সেটা আমি, আপনি, তুমি বা তুই -এর কেউই জানে না। প্রতি মুহূর্তে আমরা আমাদের আগামীকে পাবার জন্য ছুটছি, আর প্রতি নিয়ত আমাদের সংসারের দেওয়ালে অজান্তে কেটে চলেছি হিসেবের অঙ্ক। এমন এক অঙ্ক, যার শেষ প্রান্তে বসে আছে আমাদের ইপ্সিত কিছু ইচ্ছে, আর সারাটা অঙ্ক জুড়ে আমরা শুধু সেই "ফলটুকু" মেলাবার চেষ্টা করে চলেছি।
কিন্তু যদি একদিন এই অঙ্কের পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে দেওয়ালটাই শেষ হয়ে যায়? পাতার পর পাতা লেখার পরও যদি শেষ মুহূর্তে এসে মনে হয়, কিছুই তো লেখা হল না! সারাটা জীবন পিঠের রক্তাক্ত ঘামে ভিজিয়ে দেবার পরও যদি মনে হয় পাওয়ার ঝুলিটা আজও শূন্য, তাহলে? প্রশ্নটা কি খুব তীক্ষ্ণ, নাকি বাস্তবের বুক চিড়ে করে ফেলা একটা অস্বস্তিকর প্রশ্ন? উত্তর বা মতামত সকলের কাছেই চেয়ে নেব, কিন্তু তার আগে ভাগ করে নেব সেই দিনটার কথা, যেদিন হয়ত সময়ের কাঁটা একটু একটু করে ছায়া ফেলবে মুখের ওপর। যেদিন হয়তও ভাবনা চিন্তার অবকাশটুকু থাকবে না, আগামীকে মেনে নেওয়া ছাড়া। ছোটবেলায় পাঠ্যবইয়ে একটা বাক্যবন্ধ ছিল "মানুষ মরণশীল"। হ্যাঁ, আমরা প্রত্যেকেই একটা শেষের দিকে এগিয়ে চলেছি। কিন্তু শেষ হবার আগে কি করতে পারলাম, সেটা কখনও মনের গহনে প্রশ্নের আগুন লাগিয়েছে?
কেমন হত যদি আজই হত শেষ দিন। সময় যে কতটা দামী, সেটা কি বোঝা যেত? আজকের দৈনন্দিন ব্যস্ততার মাঝে আমরা কাউকে সময় দিতে পারিনা। নিজের বন্ধু বান্ধব তো দূর অস্ত, জীবনের সব চেয়ে প্রিয় মানুষটার থেকেও "সময়" না পাওয়ার অভিযোগ শুনতে হয়। আচ্ছা, দিনের শেষে যখন সাওয়ারের ঠাণ্ডা জল পিঠ বেয়ে নেমে আসে, তখন একবারও প্রশ্ন জেগেছে, "নিজের জন্য কতটা সময় দিতে পারলাম?" হয়তও শেষদিনের মুহূর্তে এই কৌতূহল গুলো ফিরে ফিরে আসবে; শিরায় শিরায় যে "নিরন্তর দৌড়ে" যাবার অক্লেশ গতি ছিল, সেদিন থেমে যাবে সময়ের শিয়রে। সময় যে কত দামী হয়তও আমরা বুঝতে পারবো।
কিন্তু শুধু কি মৃত্যুই কারো জীবনের শেষ হতে পারে? নাকি একটা গল্পের শেষও সেই একই অনুভবের পাড়ে আছড়ে ফেলতে পারে কারো জীবন? যদি, একটা মানুষের অস্তিত্ব মুছে যায় একজনের জীবন
থেকে, যদি তার সাথে হাজারও কাটানো মুহূর্তরা বারে বারে তোমায় ভাবতে বাধ্য করে, "আর পাবো না তার দেখা?......আর কোনোদিনও তাকে......" কি? ভাবতে ভাবতে কষ্টের আঁচে পুড়ে যাচ্ছে মন?
আমাদের জীবন জুড়ে গল্প রয়েছে। তাই নটে গাছটি মুড়ল - এর মতো কোনও কিছুর শেষ আমাদেরকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। আমাদের কাঁচের পৃথিবী ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়, যখন চাক্ষুষ করি কোনও গল্পের অন্তিম পর্ব। এক একটা মানুষই তো গল্প, আর গল্পের শেষ মানে তো......
জানালার বাইরে থেকে পড়ন্ত বিকেলের রোদ্দুর যখন গ্রিলের মধ্যে দিয়ে এসে ছায়া ফেলছিল ক্লাসরুমের বেঞ্চে, তখন বরুণ বসেছিল ক্লাসের এক্কেবারে শেষে, আর বারবার দেখছিল সেই ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে, যেখানে ছড়িয়ে ছিল অসংখ্য অক্ষর; তিন দিন আগেই হাতে চিঠিটা এসেছে, শহরের কোনও একটা স্কুলে বদলি হয়ে গেছে...সে। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও, বরুণ ভেবে উঠতে পারছে না, তাতান, সন্তু, অনিরবাণ, আর ওই যে "কি যেন নাম ছেলেটার"-- ওরা যখন অঙ্কের ক্লাসে এসে খুঁজবে, তখন তো তাদের "মাস্টারমশাই"কে আর দেখতে পাবে না। শেষ দিনের ক্লাসে, একবার বলেও ফেলেছিল সবার মাঝে, কিন্তু আবেগ সামলে নিয়েছিল এই ভেবে, "ওরা যদি আমার কথা ভেবে কষ্ট পায়......"। হয়তও ভুলে যাবে, নতুন টিচার আসবে ক্লাসে। শীত গ্রীষ্ম বর্ষার মতো আবার ঘুরে যাবে বছর, আর যে ব্ল্যাকবোর্ড জুড়ে এক সময় শুধু ভরে থাকতো "বরুণ স্যারের অঙ্ক" সেখানে রয়ে যাবে কিছু স্মৃতির উঁকিঝুঁকি। চোখ যেন ভিজে যাচ্ছিল বরুণের, বার বার মনে পড়ে যাচ্ছিল এই অজ পাড়াগাঁয়ের স্কুল ঘর গুলোর কথা যেখানে আর কিছু থাক না থাক, সকাল হলেই ফুলের মতো হাজারও ছোট ছোট হাসিমুখ ফুটে উঠত এখানে সেখানে। টিফিন ব্রেকের সময় টিচার্স রুমের সামনে অপেক্ষা করতে থাকা সেই ছেলেটার কথাও হয়তও মনে পড়বে, যার পড়ার বই.................. রেফারেন্স এর জন্য যে বইগুলো হাতে এসে পৌঁছাত, বরুণ তার বেশিরভাগই দিয়ে দিত তাকে, কেমন যেন একটা টান তৈরি হয়েছিল তার জন্য। আজ যেন বরুণের গল্পের শেষ, সারাটা ক্ষণ শুধু একটাই প্রশ্ন, "আর শুধু কিছু মুহূর্ত, শেষ ঘণ্টার পর তো আমি পর হয়ে যাবো সবার কাছে, আর তাদের দেখতে পাবো না, আর ওদের সাথে ছুটির বিকেলে খেলা......আর আমি..." বরুণ বেঞ্চের দিকে তাকিয়েছিল, যেখানে ছোট্ট ছোট্ট বিন্দু এসে মুক্তোর মতো জমেছিল, আর সূর্যাস্তের শেষ আলোয় ঝলসে উঠছিল তারা; হয়তও প্রদীপ নিভে যাবার আগে যেমন সব চেয়ে বেশি করে জ্বলে ওঠে, হয়ত "শিমুলগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়ের" গল্পও আর কিছু মুহূর্ত পরে শেষ হয়ে যাবে।
একই ঘটনা সুব্রতও যেন টের পাচ্ছিল, যখন তার বাদামী রঙের ব্যাগের মধ্যে খুব সন্তর্পণে গুছিয়ে নিচ্ছিল প্রয়োজনীয় কিছু ফাইল। পাশে বছর খানেক আগে কেনা ছোট্ট এফ এমে তখনও মিহি আওয়াজে বেজে চলেছে, "ও গানওয়ালা, আরেকটা গান গাও, আমার আর..."। চশমাটা খুলে ফেলে যখন সেটাকে খুব আস্তে আস্তে মুছে ফেলছিল সে, তখন এক অসম্ভব কল্পনায় সরকারি অফিসের চুন খসে যাওয়া দেওয়াল যেন বালির মতো ঝরে পড়ছিল। সূর্যের আলো তখন মিইয়ে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে, আর চশমাটা চোখে দিতেই খুঁজে পাচ্ছিল নিজেকে এক অজানা রাস্তার মোড়ে। রাস্তার দুটো দিক একেবারে অস্পষ্ট, শুধু সরীসৃপের মত একটা কালো দাগ জুড়ে রেখেছে দুটো অসীম প্রান্তকে। খুব ভয় করছিল সুব্রতর, দিশা খুঁজে পাচ্ছিল না ঠিক মতো, খানিক বাদে ঠাওর করতে পেরেছিল একটা কাঠের টেবিল, তাতে খুব সযত্নে দেওয়া রয়েছে একটা সাদা পর্দা। তার ওপর কালি, কলম, কাঁচের পেপার ওয়েট, লাল নীল সবুজ রঙের নানা ফাইল, আর একটা চায়ের কাপ। চেয়ারের পাশে রাখা সেই বাদামী রঙের ব্যাগ। যেন সব কিছু তার জন্যই সাজিয়ে রাখা আছে। কাঁচাপাকা চুল যখন কপালের সামনে নেমে আসছিল ঝোড়ো হাওয়াতে, তখন জীর্ণ হয়ে আসা ঠোঁটে নেই কোনও শব্দের হাতছানি। "সুব্রতদা আছে মানে, আপনার ফাইল পাস হবেই; অনেক ধন্যবাদ সুব্রত বাবু, আপনার জন্য আমার.........; থাঙ্ক ইউ স্যার, আপনার সাহায্যেই আমার স্কলারশিপ টা আমি......; আপনার এই উপকার আমি কোনোদিনও......; দাদা, রমেনের মেয়ের বিয়ে, কিন্তু মনে হচ্ছে একটু সমস্যাতে আছে, আপনি যদি......; বাবু, আপনার আশীর্বাদে আমার ছেলে এবার মাধ্যমিকে......; দাদা, শুধু আপনার অপেক্ষায় থাকি, কখন দুপুরবেলা এসে সেই ফ্লেকটা চাইবেন......; আরে সুব্রত, তুমি না এলে সন্ধ্যে বেলার চায়ের আড্ডা......; সুব্রত, তুমি...............খুব ভাল মানুষ, তোমায় আর দেখতে পাবো না......ভেবেই যেন......; সুব্রত, আজ বিকেলে একবার......" অজস্র মানুষ যারা জানা- অজানায় সুব্রতর জীবনের সাথে মিশে গেছিল, তাদের প্রত্যেক শব্দ যেন চারিদিক থেকে ভেসে আসছিল, যখন কাঁপতে থাকা হাতে ফাইলের ওপর রাখা ছেঁড়া খামটা সে দেখছিল। রিটায়ারমেন্টের কথা জানত সে, কিন্তু এত তাড়াতাড়ি সেটা এসে কড়া নাড়বে তার সবুজ পর্দা দেওয়া অফিস্রুমের দরজায়, সেটা সুব্রত একবারও ভেবে দেখেনি। বারে বারে শুধু ভাবছে, ত্রিশ বছর যেখানে কেটে গেল, টেবিল থেকে টেবিলে, সেই অফিসটা তো তার সংসারের বাইরে একটা "দ্বিতীয় পৃথিবী" ছিল। কিন্তু আজ যেন সেটাই উল্কার মতো ভেঙ্গে পড়ছিল তার "ছলছল" চোখের সামনে।ভাবছিল, "আর তো আমি এই অফিসে...... লিফট ম্যান বাবুলাল, সঞ্জীব, রমেন, সাগরিকা, অঙ্কুর স্যার, বড় সাহেব, তিলক দা, পানের দোকানের মিন্টু, চায়ের দোকানে ছেঁড়া স্যান্ডো গেঞ্জি পড়া ছোট্ট কাজের ছেলেটা...... এরা......এদের আর দেখতে পাবো না?"
আর মাধবী? কেমন ছিল তার গল্পের শেষ মুহূর্তের যন্ত্রণা?
বাকি কথা, আগামী পর্বে......
ধন্যবাদান্তে,
সম্পাদক-নবপত্রিকা
সম্পাদক-নবপত্রিকা
No comments:
Post a Comment