এবারের "বেরিয়ে পড়া" টা একেবারেই ধরাবাঁধা গতে ছিল না। না ছিল কোনও পরিকল্পনা, না ছিল কোনও তথ্য। শুধু ছিল, শহরের ভিড় থেকে একটু "দূরে কোথাও" যাবার ইচ্ছে। বা আরও স্পষ্টভাবে যদি বলতেই হয় তবে, একটু নির্জনতা খুঁজছিলাম প্রকৃতির ভীষণ কাছে। আমার মনে পড়ে যায়, ছোটবেলায় পাঠ্য বইয়ের পাতার রঙিন ছবি দেখে আনমনা হয়ে যাওয়া দুপুর গুলোর কথা, যখন খেয়ালি হাওয়া হঠাতই এসে উল্টে দিত বইয়ের পাতা, আর আমার শিশু মনকে ভাসিয়ে নিয়ে যেত কোনও অচেনা অজানার মাঝে। খুব ইচ্ছে করত, এই একান্ত নীরবতায় হারিয়ে যেতে কল্পনার সাম্রাজ্যে। আর সেই ঘোর তখন কাটত যখন মনে পড়ত, "রাত পেরলেই পরীক্ষা, পড়া শেষ করতে হবে"। আসলে নীরবতাও কিন্তু অনেক সময় হয়ে যেতে পারে আমার আপনার একান্ত সঙ্গী। আদতে, এটা হল একটু সময় নিজের সাথে কথা বলার, তাই না?
ঠিক তাই। আর এভাবেই একদিন বিকেলে বেরিয়ে পড়লাম, নিরুদ্দেশে। যদিও এমন "মতি" নেই বেশি দূর যেতে হয়নি। নিউ জার্সির মধ্যেই খুঁজে পেলাম এক দারুণ পাহাড়ি উপত্যকা যেখানে একই সাথে রয়েছে পাথুরে রাস্তা, ঘন অন্ধকারাচ্ছন্ন জঙ্গলের হাতছানি, সুপ্ত পাষাণের কোল ঘেঁষে শির শিরে শব্দে বয়ে যাওয়া লুপ্ত স্রোতস্বিনী, কোথাও বা ছোট্ট দুর্গম ঝর্ণা, সর্পিল আঁকাবাঁকা রাস্তা , সবুজের সাজে সুসজ্জিত বিশাল দীঘি আর............ভীষণ নির্জনতা। জায়গাটার নাম "রামাপো উপত্যকা"।
উপত্যকায় প্রবেশ করতে গেলে যেতে হয় পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে, যা কখনও উঠে গেছে খাড়া ঢাল বেয়ে, কখনও বা বেঁকে গেছে জঙ্গলের অন্ধকারে। হয়তও এক একটা বাঁকের পরই লক্ষ্য করা যাবে গভীর ঢাল। আমি শুরু করলাম একেবারে পাদদেশের সমতল এলাকা থেকে যেখানে ক্যামেরা নিয়ে থমকে যেতেই হয় সুদৃশ্য দীঘি ও জলাশয়ের সামনে। কোথাও পাহাড়ের ঢাল একেবারে নেমে এসেছে দীঘির পাড়ে, কোথাও বা ঘন জঙ্গলের অন্ধকার বুনে দিয়েছে রহস্যের নকশী কাঁথা। এমনই একটি দীঘির পাড়ে রাখা বেঞ্চের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল, যদি এখানে বসেই নামহীন কোনও অলস দুপুর কেটে যেত আমার। আরও এগোতেই চোখে পড়ল বন্য জীব জন্তু সম্পর্কে সতর্ক বাণী। বিশেষত এই জায়গায় বৃষ্টির মরশুমে সাপের উপদ্রব হয়ে থাকে।
ধীরে ধীরে শহুরে পিচের সোজা রাস্তা পরিণত হল পাথুরে কাঁকড়ে আকীর্ণ ঘোরালো উঁচু নিচু বনপথে। দুপুর গড়িয়ে যদিও তখন বিকেল, তবুও হেলানো রোদ্দুর কেমন যেন আবছা হয়ে গেল সবুজালি পাতার ভিড়ে। রাস্তার দুই পাশে প্রকান্ড গাছের সারি যা অনেকটা স্নিগ্ধ ঘন ছায়ায় মুড়ে রেখেছে জঙ্গলের নিভৃত রহস্য। আরেকটু গভীরে যেতেই বুনো নাম না জানা পাখিদের কিচিরমিচির কানে এল, যা প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল নানান প্রান্ত থেকে। আর কিছুটা এগোতে চোখে পড়ল একটা ছোট সাঁকো, যার নীচে দিয়ে বয়ে চলেছে ছোট একটা প্রবাহ। যেন সভ্যতা ও বন্য জীবন এক সংযোগ স্থল। প্রবাহ এই কারণেই বললাম যে, নিউ জার্সিতে এমন প্রবাহের সংখ্যা অগুনতি, যার কয়েকটি পরে ছোট নদীর রূপ নিয়েছে। বাকি প্রবাহ গুলি এইসব স্থানীয় নদী, উপনদী অথবা হ্রদের সাথে সংযুক্ত। এই উপত্যকার শেষ প্রান্তে আছে একটি বিশাল জলাধার ও একটি ছোট বাঁধ যা এই জলকে নিয়ন্ত্রণ করে।
সেই শেষের দিকেই আরও এগোতে বুঝতে পারছিলাম যে, রাস্তার ঢাল অনেকটা বেড়ে গেছে। এক একটা পদক্ষেপ সমতল থেকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে একেবারে পাহাড়ের উপরের দিকে। এমন আঁকাবাঁকা রাস্তায় চলতে চলতে থেমে যেতে হয় ঘন অরণ্যের শব্দ শোনার জন্য। যদি এক মুহূর্তের জন্য নিঃশ্বাস চেপে চোখ বুজে ফেলা যায়, তাহলে শোনা যাবে পাতার মড়মড় শব্দ, কোথাও বা জল্ধারার কলকল, কোথাও এলোমেলো বাতাসের হিস হিস, কোথাও পায়ের তলায় ছড়িয়ে থাকা কাঁকড়ের শব্দ, কোথাও বন্য জন্তুর যাওয়া আসার শব্দ। আবার কোথাও থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হয় শব্দের উৎস খোঁজার জন্য। জলের ধারার শব্দ খুঁজতে খুঁজতে জানতে পারলাম, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে অনেকটা গভীরে এক জায়গায় পাতার আড়ালে রয়েছে একটা সরু ঝর্ণা। এক কথায় রোমাঞ্চকর।
শেষ প্রান্তে পৌঁছলাম যখন তখন সন্ধ্যা নামছে। বেশ কিছুক্ষণ তৃপ্তির স্বাদ নিয়ে সময় কাটিয়ে তারপর প্রায় অন্ধকার হয়ে আসা জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে নেমে এলাম একেবারে পাদদেশের শহুরে উপকন্ঠে।
আপনাদের এরকম কোনও ভ্রমন অভিজ্ঞতা থাকলে অবশ্যই লিখে পাঠান আমাদের ডাকবাক্সে (info.amarbanglavasa@gmail.com) ছবি সহ।
ধন্যবাদান্তে,
সম্পাদক-নবপত্রিকা
সম্পাদক-নবপত্রিকা
Ayto sundor barnana... chhabigulo`r songe mone hoy Ami nijei jeno hnete cholechhi Rampo upatyakar`r ankabnaka rastay, pahar`er dhal`e, nodi- jharna`r kaladhwani`r sannidhye!
ReplyDeleteAsadharan... bondhu +Niharika Deb
Salute +Nabapatrika