Code

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

Second Header

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

Saturday, July 9, 2016

আজ যদি শেষ... - চতুর্থ পর্ব


সময়ের সরণি। কথাটা যতটা রূপক, ঠিক ততটাই বাস্তবের মতো কঠিন। এমন একটা পথ, যেটা চলতে চলতে আমরা হয়তও ভুলে যাই যে, আমাদের অতীত আমাদের কোথায় পৌঁছে দিল। আমরা প্রশ্ন করি, আক্ষেপ করি, নস্টালজিয়া মেখে নিই দু'গাল ভরে। অপ্রাপ্তি থাকবেই, কিন্তু আমাদের প্রাপ্তিগুলো কখনও অস্বীকার করা যায়?

ঋতু। অনেকটা এমন ভাবেই ভাবছিল চেয়ারে বসে। সন্ধ্যে নামছে শহরে। ট্যাক্সি করে আসার সময় দুচোখ ভরে দেখছিল এই শহরের শেষ সূর্যাস্ত। ঘরফেরা পাখির দলের ডানা ভিজে যাচ্ছিল তার লালচে রঙে। সারি সারি মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে থাকা বাড়িগুলোর ছাদ ছুঁয়ে দিন ঢলে পড়ছিল রাতের চাদরে। দিকে দিকে জোনাকির মতো জ্বলে উঠছিল শহুরে বাতির আলো, আর তার মাঝে নিশ্চিন্তে নিঃশ্বাস নিতে থাকা আধোঘুমে আচ্ছন্ন রাস্তা। ট্যাক্সির মিটারে যখন চলে যাচ্ছিল একের পর এক কিলোমিটারের সংখ্যা, ঋতুর কাছে রাস্তা যেন তখন ফুরিয়ে যাচ্ছিল। কখনও ট্যাক্সির বাইরে আঙুল বাড়িয়ে দিচ্ছিল একমুঠো হাওয়া মেখে নেবার জন্য। কারণ আর হয়তও কিছু সময় পরে তার জন্য, এই শহরের সব কিছু "স্মৃতি" হয়ে যেতে চলেছে। যা কিছু ছিল বর্তমান, তা চিরদিনের মতো হয়ে যেতে চলেছে স্মৃতির ক্যানভাসে দেওয়া তুলির লালচে দাগ। ধরে রাখা যায়না, এটা জেনেও যেমন আমরা দু'হাত বাড়িয়ে দিই ঝর্ণার স্রোতে, একটু তার স্পর্শ পাবার আশায়, ঠিক তেমনি ঋতুও যেন একটু আগলে নিতে চাইছিল এই "প্রেমের শহরকে"।

বিমানবন্দরের লাউঞ্জে চুপ করে বসেছিল সে, আর দুহাতের তালুর দিকে তাকিয়ে ফিরে দেখছিল বাড়ি থেকে এখানে আসার প্রতি মুহূর্তের ছবি। এত ভিড়ের মাঝেও কেমন যেন একলা মনে হচ্ছিল। প্রথমে বেশ কিছুক্ষণ পাশে টেবিলে রাখা ম্যাগাজিনে চোখ বুলিয়ে নেবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু মনকে কিছুতেই সেই রঙিন পাতার অক্ষরগুলোর মাঝে সে বন্দী করতে পারেনি। একের পর এক পাতা উল্টে গেছে, কিন্তু কোনও বিজ্ঞাপনী রং ভুলিয়ে দিতে পারেনি তার মনকে। শেষে, বাধ্য হয়েছে সেটা ফিরিয়ে দিতে সেই টেবিলে, অন্য কারো জন্য; আর চুপ করে বসে থেকেছে কাঁচের উঁচু দেওয়াল গুলোর দিকে তাকিয়ে- স্থবিরের মতো দেখেছে তার "শহর কোলকাতাকে"। লাউঞ্জে দেখতে দেখতেই যাত্রীদের ভিড় বেড়ে যেতে লাগল, একের পর এক ফ্লাইট আসছে বিমানবন্দরে, আর মুহূর্তে মুহূর্তে রয়েছে আধিকারিকদের ব্যস্ত পায়চারি, জওয়ানের টহল, রুদ্ধশ্বাসে টিকিট নিয়ে এগোতে থাকা যাত্রীরা। মাইকে বারবার ফ্লাইট নিয়ে ঘোষণা, ট্রলির আনাগোনা, আর আছে প্রিয়জনের সাথে একটু সময়ের জন্য কথা বলে নেবার ইচ্ছে। গুঞ্জন, কোলাহল, ঘোষণা, চিৎকার - এত কিছুর মাঝেও ঋতু একদম যেন 'একলা'। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল একবার, "এখনও প্রায় আধ ঘণ্টা দেরি আছে।"
কর্মসূত্রে, আজ রাতের ফ্লাইটে সে চলে যাচ্ছে নিউ জার্সি- অনেকটা সময়ের জন্য। হয়তও চিরদিনের......

প্রায় ঘণ্টা দেড়েক আগেই বিদায় জানিয়েছে নিজের মা,বাবা আর প্রিয়জনদের। চোখ ভিজেছে, ভিজেছে মায়ের মমতার আঁচল। গেটে ঢুকতে গিয়েও হাত টেনে ধরেছে বাবার, মাথা রেখে দিয়েছে বুকে আর অঝোরে কেঁদেছে। মন ভারি হয়ে গেছে, "আজ শেষ দিনের" যন্ত্রণায়। "এভাবেই কি সব শেষ হবার ছিল? মা বাবা আত্মীয় সবাইকে ছেড়ে আমায় চলে যেতে হবে? এই জন্যই কি আমি চাকরি করছিলাম? সবার সাথে যোগাযোগ থাকবে, থাকবে বন্ধনের অঙ্গীকার; কিন্তু কাছে কি পাবো তাদের? আমি যে তখন অনেক দূরে............ বহু দূরে। যে জীবনের সিঁড়ি বেয়ে আজ এখানে পৌঁছে গেছি, কখনও ভাবিনি এখানেই তার শেষ ধাপ দেখতে হবে। সবাইকে রেখে চলে যেতে হবে আমায়...... আমার মেয়েবেলা, আমার আদরের ঘর, আমার শহর। সব কি শেষ?"

গত এক মাস ধরে যখন অফিসের কর্মীরা, আত্মীয়রা যখন শুভেচ্ছা জানিয়েছে, তখন বারবার তাকে মনে করিয়ে দিয়েছে , "আর তো এই কয়টা দিন"। হাসিমুখে কথাগুলো শুনেও বুঝতে পারেনি যে সে আনন্দে ভাসবে, নাকি "ফুরিয়ে" যাবার আক্ষেপে কষ্ট পাবে? এক মাস, এক সপ্তাহ, এক দিন, এক ঘণ্টা থেকে অবশেষে হাতে বাকি রয়েছে কিছু মুহূর্ত। "বিদায় কোলকাতা ...বিদায় আমার দেশ - আমার জন্মভূমি- আমার সবুজ মাটি।"

কিন্তু এভাবেই কি সাজিয়ে রাখা ছিল তার বিদায়ের মুহূর্ত? নাকি এত কিছুর মধ্যেও লুকিয়ে ছিল কোনও ভাল লাগা? তার প্রিয় শহরের জন্য একান্ত প্রেম? হ্যাঁ, ছিল। ভীষণ ছিল বলেই যখন তাকিয়ে দেখল কাঁচের সেই সার্সির দিকে, যখন দেখতে পেল সরীসৃপের মতো রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলা শহরের ধমনী, তখন মনটা ভরে উঠল একটা আনন্দে। আর কি ছিল সেই আনন্দ? কেমন ছিল সেই ভালোলাগা?ফিরে দেখা যে সবসময়েই একটা অন্য মানে রাখে সবার জীবনে, ঋতুরও তো ঠিক তাই। তার মনে পড়ে যাচ্ছিল, স্কুলের ছুটির পর বয়েজ স্কুলের মাঠে লুকিয়ে খেলা দেখতে যাওয়া, কলেজের অফ পিরিয়ডে হাতিবাগানে সিনেমা, শ্যামবাজার মোড়ে পরীক্ষার শেষ দিনে চুটিয়ে গোলবাড়ির মাংস, অথবা একদিন শাড়ী পড়ে নিছক এক বিকেল প্রিন্সেপ ঘাট-হয়তও একান্তে একটু সময় নিজের জন্য , হাঁটতে হাঁটতে চক্ররেলের স্টেশনে গড়িয়ে আসা বিকেল, বাগবাজার ঘাটে বসে চিনেবাদাম আর বন্ধুদের আড্ডা, কুমোরটুলিতে শরতের কোনও এক দুপুরে দুলছুট হয়ে চলে আসা আর সেইখানে অচেনা গলির মাঝে বারে বারে হারিয়ে যাওয়া- ক্যামেরার লেন্সে একবার মাটির স্পর্শ আবার কখনও বা শিল্পীর ছোট্ট ধুলোমাখা ঘরে টিমটিমে আলোয় কাচামাটির প্রতিমায় আঙ্গুলের টান, গড়িয়াহাটে শাড়ী কিনতে যাবার হুজুক, ভিক্টোরিয়ার মাঠে বসে প্রেম, ক্রিসমাসের রাতে পার্ক স্ট্রীটের আলো ঝলমলে রাত,আর বর্ষবরণের রাতে প্রথম বার অনির্বাণের ঠোঁট ছুঁতে চাওয়ার ইচ্ছে, অষ্টমীর দিনে চালতাবাগানের পুজোর প্যান্ডেলে অঞ্জলি দেবার সময় ইচ্ছে করে সব ফুল "ওর" মাথায় ফেলা, বৃষ্টির দিনে একলা ছাদে দাড়িয়ে শহরকে খুব কাছের থেকে দেখার ইচ্ছে- আর সব হারানোর চেষ্টা মনে মনে, অনুসন্ধান কেন্দ্রের সামনে দাড়িয়ে হাপুস চোখে অপেক্ষা নবমীর দিনে, সরস্বতী পুজোয় কলেজের রি- ইউনিয়ন, বেনিয়াটোলার মোড়ে দাড়িয়ে তেঁতুল জলে ডুবিয়ে ফুচকা আর আলু চাট, কিম্বা হেদুয়ার কাছে লালচে ঝাল মুড়ি, "খুব খিদে" পেলে প্রোমোটিং হয়ে যাওয়া রঞ্জনা হলের পাশে এগ-রোলের ছোট্ট দোকান, অথবা একদিন নেহাতই ডায়েরি হাতে এদিক সেদিক মন যেমন চায়; অথবা কালবৈশাখীর দিনে আবদার ছাতুবাবুর বাজারে চড়কের মেলা দেখতে যাবার, হয়তও বা সকাল সকাল হাঁটতে হাঁটতে হাওড়া ব্রিজের মাঝখান যেখানে দাঁড়িয়ে তার দেখতে ভাল লাগত রোদ্দুরের আলো ছায়া জলের ওপর- যেখান থেকে সব লঞ্চগুলোর মাথা দেখা যেত- হয়তও ......... "ঋতু সেনগুপ্ত, উই আর মেকিং ফাইনাল কল ফর ইউ। প্লিজ রিচ টু ডেক, ইমিডিয়েটলি।" (Ritu Sengupta, we are making final call for you. Please reach to deck, immediately). Final call, যখন বারবার ঘোষণা হতে লাগল যাত্রীদের জন্য, তখন যেন সম্বিৎ ফিরে পেল ঋতু। এই শহরের থেকে চলে যাবার আগে, সেই শহরের বুকেই যেন হারিয়ে গেছিল মনে মনে, একান্ত ভালোবাসায়। চোখের সামনে মায়াবী মরীচিকার মতো সব যেন হাতছানি দিয়ে গেছিল ঋতুর কাছে। আর মাত্র মিনিট পাঁচেক বাকি তখন...... গাল ছুঁয়ে যাচ্ছে ভালোলাগার শিশির যা নেমে এসেছিল তার চোখের কোল বেয়ে, ভীষণ......ভীষণ আনন্দে।
বিগত সাতাশ বছরে অজস্র ঋতুর আনাগোনার মাঝে, এই "ঋতু" কুড়িয়ে নিয়েছে অনেক অনেক ভালোবাসা এই শহরের বুক থেকে। পায়ের কাছে রাখা ব্যাগটাও যেন, আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে এই শহরের থেকে নেওয়া অনেক ছোট ছোট স্মৃতি......

যখন মন ভারি হয়ে এসেছিল "শেষ হয়ে যাবার কষ্টে", তখন যেন এই টুকরো টুকরো মুহূর্তগুলোই তার হাত টেনে ধরেছিল "একবার ফিরে দেখার জন্য।" হয়তও এভাবে চলে না গেলে, এই "পাওয়া"গুলোর কথা কোনোদিনও সে ভেবে দেখত না।

আসলে আমরা যা সহজে পাই, তার কথা একবারও ভেবে দেখিনা। এই পাওয়াগুলো আমাদের মনের, আমাদের জীবনের যে কতটা অংশ "আগলে" রেখেছে তা হয়তও শেষ দিন ছাড়া বোঝা যায়না। আমরা আসলে হারাতে বড় ভয় পাই। কিন্তু শেষ দিন মানেই কি শুধু হারিয়ে যাওয়া? নাহ, মোটেই নয়। বরং এই পাওয়া গুলোকে আরও আপন করে নেবার একটা সুযোগ। ছোটবেলার স্কুল ব্যাগ থেকে আজকের ট্রলি, ঋতুর জীবনের এক একটা অধ্যায়ের সাক্ষী এই শহর। "এই শহর জানে আমার প্রথম সব কিছু"!
তাই এই মাটি ছেড়ে যেতে হলেও, যে মাটির দাগ লেগে রইল তার হৃদয়ে, তা তাকে আর বেশি করে ভালবাসতে শেখাবে "এই শহরকে"। আর বেশি করে ভালোলাগায় তাই বুঁদ হয়ে যাচ্ছিল ঋতু, আর ঠোঁটে নেমে আসছিল প্রশান্তি- "আমার জীবনের সাতাশটা বছর দিলাম তোমায়...... কোলকাতা"

এর পর বলব, রাতুলের গল্প, যখন সে হঠাৎ আবিষ্কার করেছিল নিজেকে... তার শেষ দিনে।

ধন্যবাদান্তে,
সম্পাদক-নবপত্রিকা

No comments:

Post a Comment