রাত তখন দেড়টা বাজে ঘড়িতে, দালানের কাছে ঢং ঢং করে আওয়াজ শোনা যাচ্ছে প্রতিধ্বনির মতো। কোনও প্রহরীর কঠিন শাসনে সময় কেমন যেন হয়ে গেছে নজরবন্দী, যখন তার পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে ঘড়ির টিকটিক শব্দে। বাড়ির সবাই তখন রাত্রিঘুমে আচ্ছন্ন, হয়তও জেম্মার ঘরে তখনও কেউ মিহি গলায় গুনগুন করে কথা বলছে "সই" এর মতো। কিন্তু খানিক পড়ে সেই গুঞ্জনও ঢাকা পড়ে গেল ঘুমের চাদরে। সারাটা বাড়ি তখন ঝলমল করছে সদ্য লাগানো আলোর রোশনাইয়ে- লাল- নীল- সবুজ - হলুদ- আসমানি কতই না রং সেখানে। কে বলবে যে, একটু আগে সন্ধ্যেবেলা এই বাড়ির উঠোন ভরে ছিল ব্যস্ত পদধ্বনিতে। "কই রে তোরা? আরে বাবুন কে বল জিনিস গুলো এনে দিতে! কাল সকাল হলেই লাগবে তো! আর শ্যামলকে বলে দিস, কাল একেবারে সকালে যেন ফুল দিয়ে চলে যায়। দেরি যেন না করে",মায়ের একটুও নিঃশ্বাস নেবার সময় নেই তখন। একটা লাল পাড় তাঁতের শাড়ি পড়ে, উঠোন, দালান, রান্নাঘর, ছাদের পুজোর ঘর একেবারে চষে খাচ্ছে। কখনও শাসন করছে বাড়ির ছানাপোনাদের যারা এই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছে দূর দুরান্ত থেকে। কখনও একগাল হেসে যোগ দিচ্ছে বেনারস থেকে আসা জ্ঞাতি আর বোনেদের জমাটি আড্ডায়, কখনও বা ঘুরে যাচ্ছে তার "ছোট্ট" মেয়ের সাজঘর। হই হুল্লোড়, হাসি, ঠাট্টা সব কিছু মিলে বাড়ি জমজমাট ছিল। কিন্তু এখন শুধুই নিস্তব্ধতা, যার বুক চিরে শোনা যাচ্ছে একজনের নিঃশ্বাস। সেই "ছোট্ট" মেয়েটা তখনও জেগে তার ঘরে, কারণ ছাব্বিশ বছরেও সেই মেয়ে এখনও তার মায়ের "মাধু" হয়েই রয়ে গেছে। সেই দালানময় সেই কিতকিত খেলে বেড়ানো মেয়েটার কাল তো...
চশমাটা খুলে রেখে দিল টেবিলের ওপর, যখন তার মন জুড়ে শুধু একটাই আক্ষেপ, "আজই তো শেষ রাত্রি............ এই বাড়িতে। এরপর তো সমাজের চোখে আমি পর হয়ে যাবো। যতই মা রাখুক আমায় আগলে, তবু আমি কি আর থাকতে পারবো সেই মাধুর মতো?" একান্তে এলো চুলে বসেছিল সে, তার সেই মন খারাপের ঘরে। সামনের আয়নাতে আলোছায়াতে সে দেখতে পাচ্ছে সেই মেয়েটাকে যে হঠাৎ এক লহমায় "নারী" হয়ে উঠেছে। মাধবী, যে সেই ছোটবেলা থেকে "মাধু" হয়ে গেছিল। মোবাইলের স্ক্রিনে তখন বাজছে প্রায় রাত দুটো। আর রয়েছে গুটি কয়েক মেসেজ, রাঘব পাঠিয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে সে নিজের মধ্যে প্রেমিকার থেকেও "এলো চুল করে মায়ের আঁচল টেনে ধরা মাধু" হতে চাইছে বারেবারে। আনমনে সেটা রেখে দিল বিছানার ওপর, আর তারপর একটু একটু পায়ে পায়ে এগিয়ে যেতে থাকল বারান্দা দিয়ে। পাশের ঘরেই মা আছে শুয়ে, ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেছে। একবার আধখোলা জানালা দিয়ে দেখার চেষ্টা করল ঘরের ভেতর, কিন্তু পারল না। হয়তও মাধবীর তখন মন পড়ে আছে তিন তলার সিঁড়ি দিয়ে উঠে ডানদিকের সেই ছোট্ট ঘরটার জন্য। আগামীকাল "গায়ে হলুদ", অনেক আগেই শুয়ে পড়া উচিত ছিল। কিন্তু মাধু পারেনি থাকতে, যখন বালিশে ঢেউয়ের মতো বিছিয়ে দেওয়া চুলের ওপর অভিমানী ঠোঁট রেখে সে অপেক্ষা করেছে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার। খালি পায়ে বারান্দা দিয়ে গুটি গুটি করে উঠে এলো তিনতলায়। মাধবীর "খেলা ঘর"। দরজার সামনে দাড়িয়ে তখন প্রত্যক্ষ করছিল কিভাবে স্মৃতির ঝড় আছড়ে পড়ছে, সরকার বাড়ির তিন তলার বারান্দায়- কিভাবে মন খারাপের বৃষ্টি ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে তার গাল- কিভাবে আঙুল দিয়ে বালির মতো খসে পড়ছে "আবার সেই দস্যি মেয়ে" হয়ে যাবার ইচ্ছে।
মায়ের আঁচল থেকে আগেই সরিয়ে রেখেছিল চাবিটা। আজ শুধু অপেক্ষা ছিল, সেই ঘরের দুয়ার খুলে দেবার- আরেকবার মুঠো ভরে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা তার "মেয়েবেলার" দিনগুলো। "খুট" একটা শব্দ, খুলে গেল দরজা, আর ধীর পায়ে এগিয়ে এলো "সেই মেয়েটা" ঘরের মধ্যে। আলো জ্বলে উঠল "খেলা ঘরে"। কি নেই সেখানে! মাধবী কোনোদিনও হাঁটেনই কোনও বালুচরে, যেখানে দুর্বার স্রোতের মাঝে সমুদ্রের ঢেউ রেখে যায় অজস্র ঝিনুক। কোনদিনও অনুভব করেনি পড়ন্ত বিকেলে সেই কুড়নো ঝিনুকে একটুকু ভালোবাসা খুঁজে পাবার ইচ্ছে। কিন্তু আজ এই ঘর কানায় কানায় উপছে দিচ্ছে তার মন "একান্ত ভালোলাগায়"। হ্যা, "ভালোলাগা", যা হয়তও কখনও কখনও ভালবাসার থেকেও অনেক বেশি সীমাহীন। ঢেউয়ে ভেসে আসা ঝিনুকের মতো, তার মনে পড়ে যাচ্ছে, তার ভাঙা পুতুলের বাক্স যেখানে থরে থরে রাখা আছে রাজা, রানী, রাজকন্যা আর রাজপুত্তুর; বিছানার নীচে রাখা লাল থলিতে রাখা কাঁচের গুলি, যা নিয়ে বোনের সাথে কম ঝগড়া করেনি সে; জানালার পাশ থেকে দেওয়ালের বামদিক ঘেঁষে ছোট্ট অপটু হাতে আঁকা নানান ছবি- পাশের বাড়ির মোটা গোঁফওয়ালা বেড়াল, মামার বাড়িতে দেখা শিমুল গাছ, বাস- ট্রাম- গাড়ি- আর আছে হিজি বিজি হাজারও সব বর্ণ যা দিয়ে সে ভরে দিতে ভালবাসত তার প্রিয় দেওয়াল; আয়নার সামনে আছে সেই লাল রিবন, হেয়ারব্যান্ড যেটা মাথায় দিয়ে মায়ের সামনে হাসি হাসি দুষ্টু মিষ্টি চোখে তাকিয়ে থাকতো, আর বলত, "আজ স্কুলে যাবো না......আজ আমার...... পেটে ইত্তু ইত্তু ব্যাথা"; আছে সেই নীল রঙের স্কুলে পড়ে যাবার শাড়ি যেটা পেয়ে মাধবীর মনে লেগেছিল কৈশোরের রং- একটাই শাড়ি, তবু রোজ স্কুলে যাবার আগে কেটে যেত অনেক ক্ষণ, নিজের দিকে তাকিয়ে "বড় হবার আনন্দে"; আছে আয়নার গায়ে লাগানো লালচে টিপ, যেটা হরেক অজুহাতে খুঁজে নিত একটুকু জায়গা তার কপালে "লজ্জা" হয়ে; আছে সেই কাঁচের চুড়ির বাক্স, যেখানে খুব যত্ন করে রাখা আছে ভাঙা চুড়ির টুকরো গুলো, যার আঘাতে বারেবারে কেটে গেছে হাত, তবু কমেনি সেগুলো পড়ার আনন্দ; আছে অঙ্ক বইয়ের পাতায় রাখা শুকনো গোলাপ জুড়ে প্রথম প্রেমের স্মৃতি; আছে সেই দোলনা যেখানে "বোনকে" দেখার জন্য বাবার সাথে হঠাৎই করে ফেলত ঝগড়া; আছে সেই ব্যাগের তিন নম্বর চেন, যেখানে সযত্নে রাখা থাকত রাঘবের সমস্ত চিঠি; আছে অষ্টমীর দিনে পড়া সেই হলুদ শাড়ি, যেটা রাঘব দিয়েছিল তার প্রথম মাইনে পাবার পর; আর? নাহ, হয়তও ভাষা মলিন হয়ে যাবে সেই সব কথা বলতে গিয়ে।
আঁচল ভরে আজ মাধবী কুড়িয়ে নিচ্ছে খুব "চেনা চেনা কিছু ভালোলাগা", আজ যেন তার ঘর হয়ে গেছে জোনাকির বাসা, যেখানে শত সহস্র স্মৃতি জড়িয়ে ধরছে তার পা, "মাধু, যাস না তুই.........আমায় ছেড়ে"। এই মুহূর্তে যখন এই মেয়েবেলার ঘরের কথা মনে করে, তার মন ভারি হয়ে যাবার কথা; যখন সব হারিয়ে যাবার কষ্টে কানায় কানায় উপছে পড়ার কথা;যখন মন খারাপের ঝোড়ো হাওয়ায় উথাল পাথাল হবার কথা তার "আয়না ঘেরা বাসা", ঠিক তখনই গাল ছুঁয়ে নেমে আসছে বৃষ্টি- একটা একান্ত ভালোলাগায় ভিজে যাচ্ছে তার চোখ। এতগুলো বছর যে ঘরজুড়ে আছে, সেইখানে "আজ শেষ দিনে" তার লাগছে ভীষণ ভাল। একটু এগিয়ে এসে বিছানায় বসে পড়ে, হাসছে আনন্দে- খুব আনন্দে। ছুঁয়ে দেখছে আয়না যেখানে চিরদিন থাকবে "মাধুর" ছবি; সেই বালিশ যা খুব আদরে জড়িয়ে ঘুমিয়ে যেত প্রতি রাতে বাবার কাছে গল্প শুনতে শুনতে; বোনকে রাখার দোলনা যেটার ওপর হাত রেখে কত রাত ঘুমিয়ে গেছে সে পাশে বসে; সাজার বাক্সে রাখা নোলক যেটা সে পড়তে ভালবাসে কোনও মেঘলা দিনে; জানালার লালচে পর্দা যেটা দেখতে দেখতে সে ঘুমিয়ে যেত মায়ের কোলে, যখন মা গেয়ে উঠত গুনগুন করে কোনও ঘুমপাড়ানি গান। আজ যে দুঃখগুলো ভেবেছিল টেনে ধরবে তার হাত, আজ তারা রয়ে গেল দরজার বাইরে। আর যে ভাল লাগা গুলো হয়ে গেছিল বিস্মৃত, আজ তারা মাধবীকে ভুলিয়ে দিল, "শেষ দিনের যন্ত্রণা......"
মাধবী পেরেছিল, কিন্তু ঋতুও কি তাই পারবে?
বাকি গল্প, আগামী পর্বে...
ধন্যবাদান্তে,
সম্পাদক-নবপত্রিকা
সম্পাদক-নবপত্রিকা
No comments:
Post a Comment