প্রত্যেক মানুষেরই আপন ছোটবেলার প্রতি একটা অদ্ভুত টান থাকে। বেশ কিছু ঘটনা, অভ্যাস এমনকি অনেক ছোট ছোট ভালোলাগাও মনে পড়ে যায় আমাদের ব্যস্ত জীবনযাপনের মধ্যে। সকাল বেলা চায়ের কাপে হাল্কা চুমুকে খবরের কাগজের পাতা উল্টানোর সময় স্বপ্নিলের হয়তও মনে পড়ে গেল- কিভাবে ছোটবেলায় বাবা অফিস বেরিয়ে যাবার পরই খবরের কাগজের রঙিন পাতাগুলো থেকে লাল নীল বিজ্ঞাপন বেছে নিত সে আর কাঁচি দিয়ে কেটে লুকিয়ে রাখত ড্রয়িং খাতার মধ্যে; রান্নাঘরের ঘুলঘুলি থেকে নেমে আসা রোদ্দুর যখন ছুঁয়ে যাচ্ছে অরুণিমার গাল, তখন তার মনে পড়ে পড়ার ঘরের কোণে জমিয়ে রাখা শুকতারা আর আনন্দমেলার বান্ডিল; ঋতব্রত অফিসে ব্যস্ত মিটিং সেরে বেরিয়ে আসার সময় মনে করে স্কুলের মৌখিক পরীক্ষার দিনগুলো, যখন হাজারও প্রশ্নে বিদ্ধ হতে হত তাকে; পাপিয়া দুপুরে ছেলের সোয়েটার বুনে নেবার সময় গুনগুন করে ওঠে সেই গান, যা কখনও তার মা গেয়ে উঠত অলস দুপুরবেলা কোলের ওপর আদর খেতে খেতে অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়া মেয়ের জন্য; কিংশুকের মনে পড়ে বইয়ের মলাটে লাগাবার জন্য স্টিকারের বায়নার কথা , যখন সে মোটা মোটা হিসাবের বই বয়ে নিয়ে যায় বড় বাবুর ঘরে; আবৃত্তির মনে পড়ে খেলনা পুতুল দিয়ে সাজানো তার ঝুলনের বাগান, যখন সে সদ্য বিবাহিতা হয়ে আসার পর একলা দুপুরে সাজিয়ে নেয় তার মন খারাপের ঘর। মনে পড়ে, আর মনে পড়ে বলেই আমি-তুমি- আর সব্বাই যাদেরকে নাম দিয়ে চেনা যায় না, তারা বেঁচে আছি। আমাদের বর্তমান, আমাদের এই মুহূর্তের সমস্ত ভালোলাগার মধ্যে রয়েছে আমাদের অতীতের ছায়া। প্রশ্ন উঠতেই পারে, একটি ভ্রমণ কাহিনীর ভূমিকা লেখার সময়, এমন ভাবে সবাইকে নস্টালজিক করে তোলার ঠিক কি কারণ? আচ্ছা, এবার বলেই ফেলি। বর্তমান ম্যগাজিনে প্রকাশিত ভ্রমণ কাহিনীর কথা মনে আছে? কিম্বা স্কুলে পাঠ্যবইয়ে সৈয়দ মুজতবা আলির "যাত্রাপথে"; কিম্বা স্বামী বিবেকানন্দের লেখা ভ্রমণ কাহিনী? আমার কিন্তু বেশ মনে পড়ে আজও। মামার বাড়ি গেলেই টেবিলের ওপর রাখা বইগুলো থেকে তন্ন তন্ন করে ভ্রমণ কাহিনী খুঁজে বেড়াতাম। একটা জায়গা না গিয়েও সেই জায়গায় মানস ভ্রমণের একটা চেষ্টা। ম্যাগাজিনের পাতায় বড় করে ছাপা রঙিন ছবিগুলোতে জায়গা গুলোকে কল্পনা করা; খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সেই ছবির প্রত্যেক অংশকে ফিরে দেখা। হয়তও সেই ভাবনা, সেই ভালোলাগা আজও আমার পিছু নেয়, আমার লেখার অনুপ্রেরণা হয়ে।
ওয়াশিংটন ডিসির নানান প্রান্ত ঘুরে ফেলার পর মন করছিল, আবার প্রকৃতির খুব কাছাকাছি ফিরে যাবার। আসলে, নতুনকে জানার পাশাপাশি স্বাদ ও অভিজ্ঞতা পরিবর্তনেরও প্রয়োজন থাকে। আর সেই জন্যই এইবারে এমন একটি গন্তব্য বেছে নিলাম, যেখানে থামার কোনও প্রশ্নই নেই। অবাক লাগছে? আমরা সবাই যদিও জীবনের এগিয়ে চলার মধ্যেও একই ধারণার প্রতিচ্ছবি দেখি, তবে সত্যি বলতে এবারের ভ্রমণ কাহিনী এমন এক গন্তব্যের প্রতি, যার নেই কোনও দর্শনীয় স্থান; তবু আছে অনেক কিছু- যাত্রাপথে।
হ্যাঁ, যাত্রাপথে। আগে যতবার বেরিয়েছি, ততবার লক্ষ্য থেকেছে কোনও দর্শনীয় স্থানের। কিন্তু এবারে বেছে নিলাম একটা গোটা রাজ্যকে, যা তার অভাবনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত। আর এই রাজ্যেরই এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ঘুরে বেড়ালাম, কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে। কোনও নামী স্থান নেই, নেই কোনও নির্দিষ্ট দর্শনীয় গন্তব্য, কিন্তু এই যাত্রাপথে আছে সবুজের গালিচায় মোড়া পাহাড়ের পাদদেশ, আছে দিগন্ত বিস্তৃত ক্ষেত খামার, আছে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছের ঘন সারি, আছে হঠাৎ রাস্তার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া স্রোতস্বিনী, আছে রঙিন পাতায় মোড়া রোদ ঝলমলে পাহাড়ি জঙ্গল, আছে টয় ট্রেন, আছে হ্রদের পাশে আচমকা থমকে যাওয়ার মুহূর্ত, আছে পাহাড়ের বুক চিরে এগিয়ে চলা রোলার কোস্টার রোড যা কখনও উঠে গেছে অনেক উঁচুতে, কখনও হঠাৎই খাড়া ঢাল বেয়ে নেমে এসেছে - যার দু পাশের থেকে ছায়ার চাদর নামিয়ে রেখেছে ঘন বন, আর রঙিন গাছের শ্রেণী।
নিউ হ্যাম্পশায়ার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেকটা উত্তর দিকের রাজ্য- আর সেই জন্য তুলনামূলক ভাবে শীত প্রবণ। গ্রীষ্মের দৈর্ঘ্য এই রাজ্যে বেশ কম। তবে এই রাজ্যের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের মূল আকর্ষণ হল "Fall Color". তবে এই প্রসঙ্গে বলার সময়, আমি "Fall Color" ও এর বিজ্ঞানসম্মত কারণ সবাইকে একটু জানিয়ে দিতে চাই। ভ্রমণ কাহিনী শুধুই জানার বিষয় নয়, বোঝার গুরুত্বও যে মানতেই হবে।
গ্রীষ্মের একেবারে শেষের দিকে, ধীরে ধীরে যখন দিনের দৈর্ঘ্য কমতে থাকে, তখন তা গাছের জীবনচক্রেও প্রভাব ফেলে। গাছের পাতায় সালোকসংশ্লেষের পরিমাণ কমতে থাকে, এবং পাতার মধ্যেই পাতার সবুজ অংশ (অর্থাৎ ক্লোরোফিল) মরে যেতে থাকে। এই ক্লোরোফিল মৃতপ্রায় পাতার বুকের সূর্য কিরণের সাথে ধীরে ধীরে ভেঙ্গে যেতে থাকে। আমরা সবাই জানি সাদা আলো, সমস্ত রঙের আলোর সমষ্টি। ঠিক একই ভাবে, ক্লোরোফিলও সেই আলোর সংস্পর্শে বিক্রিয়ার কারণে নানান রঙের রাসায়নিক যৌগে ভেঙে যায়, এবং সেটাই পাতার রং হলুদ, খয়েরি, ঘন লাল ও পাটল বর্ণ (Purple) করে দেয়। গোটা গাছের পাতা যখন সবুজের সাথে এমন বিভিন্ন আকর্ষণীয় প্রাকৃতিক বর্ণে সেজে ওঠে, তখন তা সত্যিই এক অদ্ভুত মাধুর্য নিয়ে আসে প্রকৃতির বুকে। একটা গোটা উপত্যকা যদি এমনই নানান রঙের বাহারে সেজে ওঠে তাহলে কেমন হবে? যদি চোখ ফেরালেই বারবার অনুমান করার ক্ষমতা হারিয়ে যায় ঝিলমিল রঙিন পাতার মধ্যে দিয়ে আসা রোদ্দুরের দিকে তাকিয়ে? যদি একটা দীর্ঘ ঘন কালো রাস্তার দুই পাশ সেজে ওঠে রংবাহারি অভ্যর্থনায়, তাহলে? এই দেশের আবহাওয়া এই রকম নৈসর্গিক দৃশ্যে অন্যতম ভূমিকা নেয়।
আমাদের যাত্রা শুরু করেছিলাম কানেক্টিকাট থেকে.....আর... (এর পরে কেমন ছিল আমাদের যাত্রা, জানতে হলে চোখ রাখুন আগামী পর্বে)।
আপনাদের এরকম কোনও ভ্রমন অভিজ্ঞতা থাকলে অবশ্যই লিখে পাঠান আমাদের ডাকবাক্সে (info.amarbanglavasa@gmail.com) ছবি সহ।
ধন্যবাদান্তে,
সম্পাদক-নবপত্রিকা
No comments:
Post a Comment