"আজই কি শেষ দেখা?"
"অবশ্যই। কেন? আবার সিনেমা হলে দেখা হবার ইচ্ছে না রাখাই ভাল। আমার বয়ফ্রেন্ড আছে"
"আমার একটুও ইচ্ছে নেই, আপনার ব্যক্তি গত সম্পর্ক জানার। শুধু এইটুকুই বলতে চাই, নিশ্চিন্ত থাকুন। সমীর তার সীমা জানে। সিনেমা দেখুন,আমি আপনার সেই ইচ্ছে মাটি করব না।"
অনামিকা কেমন যেন একটু দমে গেল, হঠাৎ এমন রসিকতার সমাপতনের কারণে। বেশ একটা গল্প গল্প মতো কথা শুরু হচ্ছিল, যেটা হঠাৎ তার "সাবধানী" পদক্ষেপে মাটি হয়ে গেল। পরের পনেরো মিনিট একদম দুজন চুপ, এবং সেই "সমীর" একেবারে নিষ্ঠার সাথে সিনেমা দেখতে মগ্ন। পাশে সদ্য যৌবনা এমন একটা মেয়ে বসে আছে, আর বেরসিক এই ব্যক্তি কিভাবে সিনেমা- সাধনায় ব্যস্ত সেটাই ভাবছিল অনামিকা। হয়তও "বয়ফ্রেন্ড" এর প্রসঙ্গ টেনে আনায় সে কিছু মনে করল। কেমন একটু উস্খুস করতে লাগল অনামিকা, একটা ইচ্ছে জাগছিল কথা বলার। বুঝতে পারছিল, সিনেমা দেখতে এসেও গল্পের প্রতি তার মন বসছে না। অনেকদিন বাদে একলা একলা সিনেমা না দেখার একটা সুযোগ এসেও মনে হল হাতছাড়া হচ্ছে।
"জল আছে আপনার ব্যাগে? একটু তেষ্টা পেয়েছিল....." কাছে বসার সময় লক্ষ্য করেছিল তার ব্যাগ। তাই অনামিকা কথার ছুতোয় চেয়ে বসল।
"কথা বলতে যখন এতই ইচ্ছে করছে, তখন জল না চেয়ে একটু কথা চাইলেও আমি কিছু মনে করতাম না", সমীর সোজাসুজি বলে দিল।
"আপনি এতটা ভাবলেন কি করে? কই আমি তো শুধু জল চেয়েছি" , অনামিকা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করল, ধরা পড়ে যাবার ভয়ে।
"আপনার আঙুল নিয়ে আপনি বেশি খেলা করেছেন, সিনেমা দেখার চেয়ে। এটুকু আপনি না ভাবলেও, আমি লক্ষ্য করেছি। যাই হোক জল আমার ব্যাগে আছে। দিচ্ছি। আর কিছু লাগবে? আমি এনে দিতে পারি আপনার সাহায্যের জন্য। " তারপরই ব্যাগ থেকে সব জিনিস বার করার চেষ্টা করল সমীর। একটা বই অনামিকার হাতে ধরিয়ে বলল, "একটু ধরুন এটা। নাহলে বোতল টা বার করতে পারব না" অন্ধকারে বেশ ভারি ভারি ঠেকল সেটা। তারপর বোতল হাতে দিল সমীর, "পুরোটা শেষ করে দিলেও ক্ষতি নেই। আপনি খেতে পারেন"।
"হ্যাঁ, চিপসের প্যাকেট টা?" অনামিকা সেই তার সৌজন্যের এমন পরীক্ষা নেবে সেটা সমীরও হয়তও ভাবেনি।
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে সে বলল, "মনে হচ্ছে, আপনি সত্যিই মজা করছেন। এখন সবে জমে উঠেছে সিন, আর আপনি আমায় যেতে বলছেন?" সমীর হাসল তার দিকে চেয়ে, কারণ বিশ্বাস হচ্ছিল না অনামিকা সত্যিই তাকে আবার উঠে যেতে বলছে।
অনামিকা কোনও প্রতিক্রিয়া না জানিয়ে, শুধু বোঝাতে চাইল যে, "সে তার আবদারে অনড়"। সত্যি বলতে সমীর এই মুহূর্তে "না" করে দিতে পারত। "কিই বা যায় আসে? একজন অচেনা মানুষ, হয়তও আর কোনোদিনও দেখা হবে না। তার জন্য এত ঝামেলা পোহানো আদৌ কি দরকার? তবু, সে পাশে বসতে দিয়েছে, নাহলে তো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ..."
"আচ্ছা" বলে উঠতে গেল সমীর এবং অনামিকার সামনে দিয়ে যখন একেবারে রো থেকে বেরিয়ে যাবার মুখে, তখন অনামিকা আবার বলে উঠল, "আরে তুমি সত্যিই চলে যাচ্ছ? বোকুরাম। এদিকে এসে বসও। আমি বললাম বলেই.........কেন একটা মেয়েকে না বলতে মেল ইন্সটিঙ্কটে বাধে?"
"ও দাদা, সামনে গার্ড হচ্ছে। আপনাদের সাংসারিক ব্যপার বাইরে মেটান না প্লিজ" পিছন থেকে উড়ে এল আল্টপকা মন্তব্য।দুজনের খিটিরমিটির চলছিলই, তাই কথা শুনতেই হল।
সমীর আবার সিটে গিয়ে বসল। কিন্তু এবার চুপ করে, একটু রাগী হয়ে। কিছু বলল না অনামিকার দিকে চেয়ে। অনামিকা অনেক বার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইল, কিন্তু সমীর মনে হয় অনেক বেশি করে নিজেকে সিনেমা দেখতে ব্যস্ত রাখল। অনামিকার মনে কেমন যেন একটা "অস্বস্তি" জাগছিল, "শুধু শুধু তাকে প্রথমে বসতে দিইনি, তারপর এভাবে উঠবস করানও। একটু বেশিই দুষ্টুমি হয়ে গেল মনে হচ্ছে।" অনেকক্ষণ ভাবছিল এসব, কিন্তু এদিকে পর্দায় এগিয়ে চলেছে গল্প। কিন্তু কোনও "বোরিং" গানের সিকয়েন্স শুরু হলেই, অনামিকা ভাবছে ঠিক কোনও সময়ে আবারে একটু কথা বলা যায়, বা আদতে "সরি" বলা যায়।
ইন্টারভাল হতেই সমীর উঠে পড়ল, আর অনামিকা কিছু বলার আগেই সে ওই রোয়ের অন্যদিকের থেকে বেরোবার চেষ্টা করল, যাতে অনামিকা কে এড়িয়ে যেতে পারে। অনামিকা ভাবল একবার ডাকবে, কিন্তু কেমন যেন থেমে গেল। এখন হলে আলো আছে, নিশ্চয় সমীর তার সিট খুঁজে নেবে। হয়তও আর দেখা হবে না তাদের দুজনের। অনামিকা এই কথাটা অত্যন্ত সহজে এড়িয়ে যেতে পারত, ভাবতেই পারত "এমন অনেক অজানা মানুষের সাথে আমাদের দেখা হয়, তাদের সবাইকে এভাবে মনে রাখতে পারা অসম্ভব। কিন্তু একবার হয়তও কথা বলা যেত।" আমরা আমাদের জীবনে সব চেয়ে বেশি করে সেই জিনিসের জন্য আকুল হই, যেটা আর পাওয়া যাবে না। যেটার সম্ভাবনা প্রায় শেষের পথে। মনের গহনে শুধু একটাই ভাবনা থাকে, "আর তো পাব না তারে"।
ইন্টারভাল শেষ হয়ে আবার শুরু হয়ে গেল গল্প, হলের আলো নিভে গেল। কিন্তু সমীর এলো না। অনামিকার মন তখন অন্য কোথাও পড়ে আছে। "এতক্ষণে নিশ্চয় নিজের সিট খুঁজে পেয়ে গেছে। যাক ভালই হল। আমি যা জ্বালাতন করছিলাম। " মন ভারি হচ্ছিল তখন হাতে যেন কি ভারি ভারি ঠেকল। "আরে সেই বইটা... এখানেই আমার কাছে ভুলে ফেলে গেছে। তাহলে নিশ্চয় ফিরবে। কিন্তু কই, ও তো ব্যাগ নিয়ে চলে গেল। তাহলে......সত্যিই ভুলে গেল? সিনেমা শেষ অবধি অপেক্ষা করতে হবে। খুঁজতে হবে ওকে"।
এতক্ষণ কোনও কারণ খুঁজে পাচ্ছিল না অনামিকা সমীরের জন্য অপেক্ষা করার, বা তাকে খুঁজে দেখার। কিন্তু এইবার সত্যিই একটা বাস্তব কারণ পেল, যেটা সে মনে মনে চাইছিল। মেয়েদের মন হয়তও এমনই হয়। সোজা কথাটা বলতে লজ্জা পায় একটু। তাই একটা কারণের আড়ালে লুকিয়ে রাখতে চায় নিজের মনের সুপ্ত ইচ্ছে। তাই এখন শুধু একটু অপেক্ষা।
সিনেমা শেষ হল, হলের আলো জ্বলে উঠল। অনামিকার চোখ খুঁজে বেড়াতে থাকল সমীরকে কিন্তু অগুনতি দর্শক যখন বাহিরমুখো তখন একটা "আবছা" দেখা মুখ খুঁজে বার করা প্রায় অসম্ভব হয়ে গেল। নিজের সিটেই বসে রইল এই ভেবে, "যদি একবার চলে আসে। এই বইটা নিয়ে কি করবে সে? কোথায় পাবে তাকে?" নিজের ওপর একটু আক্ষেপ হল, "ওই ভাবে জ্বালাতন না করলে হয়তও...... এভাবে করা উচিত হয়নি।" তারপর ভাবল, আরেকটু অপেক্ষা করি, কিন্তু এদিকে লোক বেরিয়ে যেতে যেতে প্রায় আর জনা দশেক দর্শক বাকি রইল।
রাতও হয়ে গেছে। বাইরে বেরিয়ে এসে ঘড়ি দেখল "প্রায় সাড়ে দশটা বাজতে যাচ্ছে" । ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের কাছে এসে দেখল, যে কটা গাড়ি ছিল সেগুলো বেরিয়ে গেছে। আর অনেকেই টাক্সির লাইনে দাঁড়িয়ে। মোবাইলে ক্যাব বুক করবে ভাবল, কিন্তু কাছে পিঠে কোনও গাড়ি নেই। "মনে হচ্ছে স্বভূমির সামনে থেকে বাইপাসের মুখ অবধি হেটেই যেতে হবে। তার ওপর আজ শনিবার, গাড়িও কম রাস্তায়। "ওর জন্য এত ক্ষণ অপেক্ষা না করাই ভাল ছিল। বাইরে বেরিয়ে এলেই ভাল হত।"
আনমনা হয়ে যখন সিঁড়ি দিয়ে নেমে সামনের নিরিবিলি রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল, পিছন থেকে একটা ডাক শুনতে পেল, "সঞ্চারী?"
অনামিকা অত খেয়াল করেনি। "কে কাকে ডাকছে, তাতে অত ভাবেনি"
কিন্তু এবার পিছনে বেশ কাছ থেকে কেউ এসে আবার ডাকল, "সঞ্চারী? আমার বইটা......?"
সমীর কিংশুক হয়েও "সমীর" হয়ে গেছিল অনামিকার জন্য, কারণ "নাম ছিল অজানা"। সমীরও জানতে পারেনি সেই "মেয়েটার" নাম। অনেকক্ষণ হলের বাইরে অপেক্ষা করেছে তার জন্য, আর যখনই দেখতে পেয়েছে তখনই ডাকতে চেয়েছে। কিন্তু কি বলে ডাকবে?তাই অনামিকা যেমন করে সাজিয়ে দিয়েছিল এই "অজানা" মানুষটার নাম, তেমনই সমীরও ডেকেছিল তাকে "সঞ্চারী" বলে।
অনামিকা পিছন ফিরে দেখতে পেল, সেই ছেলেটাকে, যার কথা এতক্ষণ সে ভেবেছে। "বইটা জলে ফেলে দেব যদি আরেকবার সঞ্চারী বলে ডাকো আমায়। তোমার জন্য আজ আমার দেরী হয়ে গেল। "
ছেলেটা একগাল হেসে বলল, "একেবারে তুমি বলে দিলে? আচ্ছা, চিপস খাবে? আমি বাড়ি পৌঁছে দেব। বিশ্বাস করলে, আর পাঁচটা মিনিট খরচ করতেই পারো। আর........."
অনামিকা হাতে বইটা আঁকড়ে ধরে তার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, "আর?"
সমীর ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, "আমি ছাড়া আর কেউ কোনোদিনও তোমায় সঞ্চারী বলে ডাকবে না"...
ধন্যবাদান্তে,
সম্পাদক-নবপত্রিকা
**আজকের লেখাটি "বৃষ্টি" -এর জন্য রেখে দিলাম উপহার হিসাবে। আপনাদের শুভকামনাও চেয়ে নিলাম তার একমুঠো হাসির জন্য।সম্পাদক-নবপত্রিকা
No comments:
Post a Comment