Code

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

Second Header

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

Monday, February 22, 2016

দ্বিতীয় বসন্ত



"না চাহিলে যারে পাওয়া যায়, তেয়াগিলে আসে হাতে..."

রোদ্দুর পড়ে যাবার পর শীতের দিনে বেশ আচ্ছন্ন একটা আবেশ আসে; আর পরিবেশটা যদি প্রকৃতির কাছাকাছি কোনও এক জায়গায় একলা দুপুরের শেষে চুইয়ে পড়া বিকেল হয়, তাহলে চোখের পাতা নিবিড় শান্তিতে আধোঘুমে আবিষ্ট হতে বাধ্য।আজ ঘরের ভেতরটা বেশ অন্ধকার। সুন্দর করে গোছানো ঘরের এক প্রান্তে একটা উন্মুক্ত জানালা।জানলার পাশ থেকেই শেষ রোদ্দুরের আলো এসে পড়ছে লাগোয়া খাটে। মাঝে মাঝে পাহাড়ি হাওয়ায় পর্দাগুলো এলোমেলো হয়ে মেঝের ওপর ছায়ার আঁকিবুঁকি কেটে যাচ্ছে। আর পাহাড়িয়া রোদ্দুরের শেষ ওমটুকু গায়ে মেখে গুটিসুটি মেরে বসে আছে সেই মেয়েটা। নাহ, একসময় মেয়েই ছিল, আজ একজন স্বয়ংসম্পূর্ণা নারী। তবে এই রকম বিকেলের স্বাদ বার বার ওকে ফিরিয়ে দিয়েছে নীরব স্মৃতি চারণায়।এমন অনেক বিকেল কেটেছে ওর মায়ের কোলে মাথা রেখে, যখন ওর আঙুল বারে বারে আঁকড়ে ধরেছে শাড়ির সুতোয় সুতোয় মিশে থাকা স্নেহের নকশি-কাঁথার উষ্ণতা, যখন মায়ের হাতের ছোঁয়া বিলি কেটে গেছে ছোট্ট মেয়েটার গালে, বয়স পেয়ে যাওয়া এলো চুলের মধ্যে- আর ঘুমে লুটিয়ে দিয়েছে চোখের পাতা, যখন মায়ের ঠোঁটে কখনও গুনগুনিয়ে উঠেছে রবিগানের কলি।

কিন্তু আজ সঞ্চারী পারেনি। চোখ বুজে অনেকক্ষণ কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল, হয়তও বেখেয়ালে ভেবেওছিল মনের মধ্যে জমে থাকা পুরনো সুর, অথবা নেহাত কোনও রেডিও ষ্টেশনের অনুরোধের আসর। কিন্তু খানিক বাদে খেয়াল হল, এই ভায়োলিনের সুর তো...। নিভে আসা আলোয় ভেজা বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল, এলো চুল শক্ত করে টেনে বাঁধল ক্লিপ দিয়ে, এলিয়ে দিল কাঁধের একপাশে। আলুথালু হয়ে যাওয়া শাড়িটা আবার বুকের কাছে টেনে বেশ মনোযোগ সহকারে শুনতে লাগলো সেই ভায়োলিনের সুর।শালটাকে জড়িয়ে নিয়ে ধীর পায়ে এগোতে থাকল, কাঁচের আরশির দিকে, পর্দা সরিয়ে জানার চেষ্টা করল এই সুরের উৎস। পর্দাটা সরাতে আরও স্পষ্ট করে বুঝতে পারল, সুরটা ভেসে আসছে পাশের কটেজ থেকে। শুনতে শুনতে, পর্দার কোণা ধরে, কেটে গেছিল বেশ খানিকক্ষণ। কিন্তু একটা সুর শেষ হতেই যখন আরেকটা সুর উঠে আস্তে থাকল ভায়োলিনের মূর্ছনায়, স্থির করল সেই বাদকের কাছে পৌঁছে যাবার। দরজা খুলে যখন বেরিয়ে এলো বারান্দায়, তখন প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেছে; দূরের মালভূমি আর টিলা গুলো আস্তে আস্তে কুয়াশার চাদরে ধেকে ফেলেছে নিজেদের আরেক নিবিড় রাত্রির জন্য। দূরে গেট কিপাররা কাঠের আগুন জ্বেলে আড্ডায় মশগুল, তাদের উচ্চস্বরে দেশোয়ালি কথা মৃদুভাবে ভেসে আসছে কানে। শালটাকে আরেকটু ভাল করে মুড়ি দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময়ই চিন্তাটা এলো মনে। কেন জানিনা, একটা অজানা উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা সঞ্চারীকে বেশ ভাবিয়ে তুলল,"যদি......"।

তবু লজ্জা, দ্বিধা আর বিভিন্ন সম্ভাবনাকে সঙ্গী করে পাশের কটেজের দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। দরজাটা খোলা, ঠাণ্ডা হাওয়া প্রায় শনশন করে ঢুকছে ঘরের ভেতর, একজন ব্যক্তি দরজার দিকে পিছন ফিরে বসে আছে, গায়ে সাদা শাল জড়ানো। মাথা হেলিয়ে, একের পর এক রবিকথা বেঁধে চলেছে তার সুর-যন্ত্রে। এতটাই মগ্ন যে খেয়ালও করেনি, ঘরের আলোগুলো এবার জ্বালতে হবে। আধো অন্ধকারে, খুব একটা স্পষ্ট কিছু বোঝা যাচ্ছিল না, তার অবয়ব ছাড়া। হয়তও মনে মনে গুনগুন করতে আরও বেশী ব্যস্ত ছিল সঞ্চারী। খানিক বাদে, সেই ব্যক্তি যখন উঠে আলো জ্বেলে আনমনে আরাম কেদারার দিকে আসার সময় পিছনে দরজার দিকে তাকাল, তখন এক লহমায় সমস্ত স্মৃতি বন্যার মত ভাসিয়ে নিয়ে গেল একে অপরের দিকে আকুল ভাবে চেয়ে থাকা দুটো মানুষকে। সঞ্চারী সন্দেহ করেছিল, কটেজ থেকে নেমে আসা সিঁড়ির প্রথম ধাপেই, কিন্তু বিশ্বাস করতে পারেনি, ভাবেনি এত দূরে, এই ভাবে আবার কোনও "অ"চেনার সাথে আবার এভাবে দেখা হয়ে যাবে, তাও এমন এক নামহীন সন্ধ্যাবেলায়। এভাবেও যে দুজনের পথ আবার "চৌরাস্তার" মোড়ে মিশে যাবে তা কল্পনাতীত ছিল অরুণেরও।
অরুণ বিন্দু মাত্র বিচলিত না হয়ে খুব স্বাভাবিকভাবে হাসল সঞ্চারীর দিকে।মনের মধ্যে একটা তীব্র অস্বস্তি, যন্ত্রণা, ক্ষোভ থাকলেও মুখে প্রকাশ করল না, বরং একেবারে জানা বন্ধুর মত এগিয়ে এলো দরজার দিকে।যেন কোনোদিন কোনোকিছু ঘটেনি দুজনের মধ্যে।

"একি সঞ্চারী, তুমি ভেতরে আসবে না?"

সঞ্চারী তীব্র বিতৃষ্ণায় ভেবেছিল দরজা থেকেই চলে যাবে, হয়তও মুখ ফিরিয়েও নিয়েছিল চোখাচোখই হতেই, কিন্তু পরমুহূর্তে নিজের সেই দ্বিধার কথাও মনে করেছিল; যখন "সেই চেনা" সুরের সাথে "সেই চেনা" মানুষটার সাথে দেখা হয়ে যাবার সম্ভাবনা মাথায় রেখেও পা বাড়িয়েছিল অরুণের কটেজের দিকে। প্রথমে খেয়াল না হলেও, স্মৃতির চাদর এতটাও পুরনো আর পুরু নয় যে অতীতের "দগদগে ক্ষত" এত সহজে লুকিয়ে রাখতে পারে। হয়তও এক পা এক পা করে এই টুকু দূরত্ব পর করার সময় বারবার ভেবেছে "যদি, তার সাথেই আবার দেখা হয়?..."। সত্যি বলতে বেখেয়ালে চেয়েওছে দেখা হয়ে যেতে। তখন তো মুখ ফিরিয়েই নিতে পারত, কিন্তু জানার ইচ্ছে "কেমন আছে মানুষটা" তাকে ফিরে যেতে দেয়নি। খানিকক্ষণ স্থিরভাবে নীরবে মাথা নিচু করে তাকিয়ে থেকেছে "চৌকাঠের" দিকে। লোক কথায় আছে, "মেয়েদের নাকি জীবনে চৌকাঠ দু'বার পেরোতে হয়; একবার বিবাহ, আরেকবার শেষ যাত্রা..."। কিন্তু সঞ্চারীর তৃতীয় বার সেই চৌকাঠ পেরনোর অনুভূতিটা বড়ই দ্বিধাময়।

"তুমি, চলে গেলে কষ্ট পাব..." অরুণ, সঞ্চারীর লজ্জায় নিভু নিভু মুখের দিকে তাকিয়ে আরেকবার অনুনয়ের সুরে বলল।
সঞ্চারীও মনে মনে এই অনুনয়টুকু শোনার জন্য অপেক্ষা করছিল। হয়ত এটা নেহাতই একটা নারী মনস্তত্ত্ব, যেখানে মেয়েরা চায় না কোনও কিছু মুখ ফুটে বলতে, বরং অপেক্ষা করে সেই কথাটা তার জন্য অন্য কারও মনে আসতে। ধীরে ধীরে, ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে ভেতরে এলো, আর দরজাটাকে সন্তর্পণে ভেজিয়ে দিল, যাতে শীতের বেদুইন প্রবাহ, দুটো মনের মধ্যে দীর্ঘ চার বছর ধরে জমে থাকা অজস্র কথার উষ্ণতাকে নিভিয়ে না দিতে পারে। অরুণ আগ্রহভরে একটা চেয়ার টেনে দিল বসার জন্য, আর নিজে বসল বিছানার পাশে।

বেশ আগোছালো ঘর, ভায়োলিনটা খুব সযত্নে খাটের পাশে রাখা। গীতবিতানের ওলটানো পাতা, আধ খাওয়া চায়ের কাপ, ট্রে-এর ওপর জমে থাকা সিগারেটের দলা, দলীয় কিছু মানিফেস্টো, দুটো মোবাইল, একটা ডায়েরি আর তার পাতায় জড়িয়ে থাকা একটা পেন, কিছু টুকরো পাতা এধারে ওধারে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানও। অরুণ শান্তভাবে বসে পায়ের দিকে তাকাচ্ছিল; না নিজের নয়, সঞ্চারীর, কিছু পুরনো ঝড় কেড়ে নিচ্ছিল দুটো মানুষের ঠোঁটের থেকে খসে পরা এক একটা না বলা কথা।

"তুমি সিগারেট এখনও ছাড়নই? এভাবে চললে তো...", নীরবতার অবগুণ্ঠন সরিয়ে সঞ্চারীই প্রথম কথা বলল, তারপর "অনেকদিন পর" মানুষটার মুখের দিকে তাকাল। খোঁচা খোঁচা দাড়ি সারাটা মুখে, খদ্দরের পাঞ্জাবী, উস্ক খুস্ক অবিন্যস্ত চুল নেমে এসেছে অরুণের ভরাট কপাল বেয়ে। স্বাস্থ্য আগের মত নেই।

অরুণ হেসে বলল, "আর এই... পার্টির কাজে এখান ওখান। বিধায়ক হবার পর, দায়িত্ব চাপ, সবই বেড়ে গেছে। কত কিছুই তো জীবনে ছেড়ে দিতে হল চোরাবালির মাঝে, এটুকুই থাক, সঙ্গী হয়ে...আমার সাথে।"

কথা গুলোর শ্লেষের ক্ষুরধার সঞ্চারী আঁচ করতে পারছিল।প্রত্তুতরে বলল, "বুঝলাম, জীবনে সব কিছু তো ধরে রাখা যায়না, অরুণ। সেটা তুমি ভাল করেই জানও। হয়তও কিছুটা হলেও সেটা ব্যক্তিগত ব্যর্থতা।" সঞ্চারী চায়নি এভাবে জবাব দিতে, কিন্তু বলে ফেলার পর খেয়াল হল। অরুণ চিরকালই মুখচোরা ছেলে, এখনও নিজেকে শুধরে নিতে পারেনি- পরিবর্তন করে নিলে আজ হয়ত এভাবে দুজনে একে অপরের সাথে "কথা বলার চেষ্টা" করতে হত না। কথাটা শুনে অরুণ ভায়োলিনের তারে নিজের মনে হাত বোলাচ্ছিল। তাই বাধ্য হয়েই সঞ্চারীকে আবার নরম হতে হল।হাজার হোক, এই ছেলেটাকে খুব কাছ থেকে দেখেছে অনেকদিন, তাই আজও একটা সহানুভূতি কাজ করছিল।

"আমি জানতাম না তুমি এখানে আছো। তোমার ভায়োলিন শুনে, আমার মনে হয়েছিল একবার...তাই দেখতেই চলে এলাম। আশা করি, তুমি বিরক্ত হওনি।"

অরুণ একটা সিগারেট ধরিয়ে হেসে বলল, "উফ, সঞ্চারী, এত ফর্মাল হবার কি সত্যিই দরকার আছে?"

"আমি আজও সিগারেটের ধোঁয়া সহ্য করতে পারিনা, অরুণ..."

বেশ লজ্জার সাথে অরুণ তৎক্ষণাৎ নিভিয়ে দিল, ভুল বুঝতে পেরে। আসলে আগে সব সময়ই আড়ালে খেত, কিন্তু বিগত কয়েক বছরে অভ্যাসটার বেশ পরিবর্তন হয়ে গেছে।তাই হয়ত ভুলবশত...

"তা তুমি হঠাৎ এখানে, অফিসের কাজ থেকে একটু বিরাম বুঝি? তোমাদের কর্পোরেট লাইফে জানলারা পাল্লা গুলো এত ছোট যে, এরকম নিবিড় নির্জনে ছুটি...ভাবাই যায়না...তা তোমার সাথে আর কেউ?"

সঞ্চারী অরুণের কৌতূহল আন্দাজ করে বলল, "আমি একাই এসেছি। সত্যি বলতে সুযোগ খুবই কম, একটু প্রাণ খুলে শ্বাস নেবার। তাই প্রোজেক্টের চাপ শেষ হয়ে যেতেই, একনিমেষে দলছুট এখানে।"

"দলছুট! বাহ কথাটা তো বেশ সুন্দর বলেছ...দলছুট। বেশ কাউকে না বলে, অনেক দূরে, একলা নির্জনে। একটুখানি সময় যখন কোনও পিছুটান থাকবে না।শুধু কথা বলা যাবে, নিজের অনুভূতি গুলোর সাথে, তাই না?"

সঞ্চারী বেশ অবাক হয়ে দেখছিল অরুণের উৎসাহ, "তুমি এখনও লেখালিখি কর? এই ডায়েরিটা..."

লাজুকভাবে ডায়েরিটা হাতে নিয়ে বেশ কয়েকটা পাতা উল্টিয়ে অরুণ বলল, "কথাগুলো তো এসেই যায়। ধরে রাখার পাত্র বলতে এইটাই রয়ে গেছে। আর তো কেউ নেই, যে তার সাথে ভাগ করে নেব? তবে মজার জিনিস হল, এই ডায়েরিতে আমার দলের জন্য লেখা গান, কবিতা যেমন আছে, তেমন ফেলে আসা রাস্তাগুলোর অলিগলিও হয়ত খুঁজে পাওয়া যাবে। ইদানিং দিল্লীর চাপ একটু কম। হাজারও ব্যস্ততার মধ্যেও একটু খানি সময় বার করে নিই শুধু নিজের জন্য। এখন তো অনেক সময় একলা হয়ে যাবার পর। তাই এইসব আর কি। "

খানিক্ষণ থেমে জিজ্ঞেস করল অরুণ, "আচ্ছা, তুমি আর লেখা লিখি করোনা? চিঠি লেখা বা পড়া?"

দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে মুখ নামিয়ে সঞ্চারী বলল, "নাহ, সময়ই পাইনা আর। এইত কয়েকটা দিন পেলাম কাটানোর জন্য, তাও কতদিন বাদে।"। একটু থেমে জিজ্ঞাসু ভাবে বলল, "ঠিক কেন বলতও?"

"নাহ, কিছু না...এমনি জানতে ইচ্ছে হল।", অরুণ কথাটা এড়িয়ে গেল, মুখ নামিয়ে। একটু যেন কেমন ভাবুক হয়ে গেল। সঞ্চারীর কেমন যেন ব্যপারটা ঠিক ঠেকল না। তাই কথা পরিবর্তন করে বলল,"ভায়োলিনটা যে আজও বাজাও, দেখে বেশ ভাল লাগল..."

বসে থাকতে না পেরে উঠে পড়ল সঞ্চারী, ঘরের আসবাব গুলো দেখতে থাকল। অনেকটা নিজের ঘরের মত মনে হছিল। একটা জড়তা অবশ্যই ছিল, কিন্তু সেটা এই কথাবার্তায় বেশ খানিকটা কেটে যাচ্ছিল, যখন বুঝতে পারছিল, কিভাবে অরুণ আস্তে আস্তে নিজের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা খড়কুটো সম্বল করে বেঁচে আছে। কখনও কবিতার ডায়েরি, কখনও গানের কথামালা হয়েছে তার সঙ্গী। কিন্তু কই এমন তো হবার ছিল না?শুধু গান, কবিতা, আর একাকী বিকেলে সুর তো কোনও মানুষের আশ্রয় হতে পারেনা! এর জন্য সঞ্চারীও কম দায়ী নয়। যখন আঙ্গুল ছুঁয়ে যাচ্ছিল সারি সারি গল্প আর উপন্যাসের বই, তখন বলে উঠল,"আচ্ছা অরুণ, তুমি এই সব বইগুলো এভাবেই সঙ্গে নিয়ে যাও? বেশ কষ্ট সাধ্য ব্যপার তো" কথাটা বলতে বলতে হাতে এল "চোখের বালি" উপন্যাস।খুব চেনা এই মলাটে বাঁধানো বইটা; বিয়ের প্রথম বছরে, অরুণের জন্মদিনে দিয়েছিল। প্রথম সাদা পাতায় নিজের হাতে লেখা "শুধু তোমার জন্য... ইতি সঞ্চারী"। কেমন যেন ঘোর লেগে গেল ওর, যখন ফিরে তাকালও অরুণের দিকে।

"এই কটেজটাতে আমি মাঝে মাঝে আসি বলে, এখানে এই বইগুলো সাজানোই থাকে। আমি বলেছিলাম নিয়ে যাবার কথা, কিন্তু রাম সিং অনুরোধ করেছিল। আমিও বাধা দিইনি। বলে কিনা, এম এল এ সাহিবের জন্য এটুকু না করলে খারাপ লাগবে বাবু।" হেসে উঠল অরুণ।

ঘরের অবিন্যস্ত রূপটা কোনও মতেই ভাল লাগছিলো না সঞ্চারীর। জীবনের প্রতি তার দৃষ্টি ভঙ্গী বেশ পরিপাটি। অগোছালো মানেই, অনেক কিছু হারিয়ে যাওয়া। জীবনেও হয়ত তাই, একজন যদি খামখেয়ালী হয়, আরেকজনকে তো এগিয়ে আসতেই হয়, তার হাত শক্ত করে ধরে রাখার জন্য। দুটো মানুষ যদি একই রকম হত, তাহলে পৃথিবীতে বৈচিত্র্যই থাকত না, থাকতো না প্রেমের রঙ। একটু ভাল- একটু মন্দ-একটু মানিয়ে নেওয়া, এর নামই কি ভালবাসা নয়?

"তুমি একটু ওঠো তো?"

অরুণ বেশ আশ্চর্য হল হঠাৎ এইরকম কথা শুনে।

"হ্যাঁ, উঠে পড়... কি বিশ্রী অবস্থা ঘরটার। একেবারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, এভাবে থাকো কি করে?"

অরুণ এবার বেশ অবাক হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে, সরে গেল ঘরের কোণে। আর আশ্চর্যের সাথে দেখতে লাগল সেই মেয়েটাকে, যে প্রথম বার কলেজ ষ্ট্রীটে প্রেসিডেন্সীর মেসে এসে এই কথাটাই বলেছিল আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগে। তখন সদ্য সদ্য প্রেম। বেথুনের ক্লাস আগে শেষ হলেই, ট্রামে করে কলেজ ষ্ট্রীটের বই পাড়া, অথবা চুপচাপ হেদুয়ার ক্লাবের ধারে বসে গল্প।অনেক বার মানা করেছিল অরুণ, কিন্তু প্রায় জোর করেই সটান পৌঁছেছিল ওদের মেসে, আলাপ করেছিল ওর বাকি বন্ধুদের সাথে। আজকেও যেন সেই মেয়েটাকে দেখতে পেল, নিপুণ হাতে আঁচল শক্ত করে কোমরে বেঁধে একটা একটা করে জিনিস ঠিক ঠিক জায়গায় সাজিয়ে রাখতে। এলিয়ে পড়া ঘন চুল বার বার গাল ছুঁয়ে নেমে আসছিল বুকের ওপর, তাই ক্লিপ খুলে ঠোঁটের ডগায় রেখে ঘরণীর মত খোঁপা করে নিল।

"তুমি এখনও এতটা ভাব?"

"আমি সবার জন্য ভাবি অরুণ। তোমার জন্যও ভেবছি।কিন্তু কোনও কিছুই তো ঠিক হল কই?"

খানিকক্ষণ চুপ থেকে গীতবিতান হাতে তুলে নিল, সাজিয়ে রাখল ডেস্কের ওপর। তার পর সেই দিকে তাকিয়েই, অরুণের দিকে পিছন করে বলে উঠল, "কি ভুল ছিল, কি ঠিক আজ আমি বিচার করতে চাইনা।এই নিয়ে আর ভাবতেও ইচ্ছে করে না। শুধু ভুলে যেতে চাই, ভুল ভেবে..."

অরুণ চুপ করে মাথা নিচু করে কথাগুলো শুনছিল, তারপর বুঝতে পারল, হয়ত দুজনেই খুব গম্ভীর আলোচনায় লিপ্ত হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। আসলে এড়িয়ে যাওয়াও এতটা সহজ ছিল না। অরুণ আর সঞ্চারীর জীবনের বেশ কিছুটা সময় যে একসাথে কেটেছে। প্রেসিডেন্সীতে ছাত্রাবস্থায় শ্যামল বিশ্বাসের কাছে হাতে খড়ি অরুণের। একটা সময় যুব সম্পাদকও নির্বাচিত হয়। ছাত্র আন্দোলনের সময় পুলিশ লকআপে যখন অরুণের অর্ধনগ্ন দেহে লাঠির ঘায়ে একের পর এক লেখা হয়েছে অত্যাচারের কথা, যখন বার বার অচৈতন্য হবার আগে লালাঝরা ঠোঁটে গুঙিয়ে উঠেছে, "বিপ্লব চলবে, মানুষের জন্য লড়বই...বিপ...", যখন দগদগে পিঠের থেকে নেমে এসেছে রক্তিম সংগ্রামের নির্যাস, তখন এই মেয়েটাই পেরেছে বেঞ্চে বসে, দাঁতে দাঁত চেপে অপেক্ষা করতে, ছাড়িয়ে নিয়ে যাবার জন্য।বারবার আর্তনাদে, যখন একে একে ওর বন্ধুরা সরে গেছে, মেয়েটা সারা রাত অপেক্ষা করেছে ওর জন্য। একটুও কাঁদেনই, শুধু চোখ লাল করে অরুণের লুটিয়ে পড়া শরীর বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে, আঁকড়ে ধরেছে ওর চুল। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে, আর যাই হোক, অরুণকে এই পথে আর হাঁটতে দেবে না। ভেবেছে বিয়ের পর মানুষটাকে নিজের মত করে গড়ে তুলবে। কিন্তু বাস্তব অনেক্তাই ভিন্ন ছিল।

নীরবতা ভেঙে অরুণ বলে উঠল, "চলো না, একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি।"

"এই অন্ধকারে? কোথায় যাবে?ঠাণ্ডাও আছে..."

"আমি আছি তো?"

অরুণের এই কথাটার পর সঞ্চারী "না" বলতে পারেনি। হাজার হোক, এই মানুষটাকে একদিন বিশ্বাস করেছে, বিশ্বাস করেছে প্রতিটি ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে যখন তার আঙুল ছুঁয়ে গেছে অরুণের ঘেমে যাওয়া পিঠের সহস্র লাঠির ঘায়ের ক্ষতের ওপর। এগিয়ে এসে বলল, "চলো কোথায় যাবে?" ঠিক যেভাবে কলেজের সময় অনেকক্ষণ অরুণকে অপেক্ষা করানোর পর ছুটতে ছুটতে এসে বলত, "কিছু মনে করো না প্লিজ, করবী ম্যাডামের ক্লাস শেষ হতে দেরি হয়ে গেল। চলো, কোথায় যাবে?" অরুণ কিছু বলত না, শুধু হাতটা ধরে হাঁটা লাগাত, যেদিকে দু চোখ যায়। আজ অনেকটা সেই রকমই মনে হচ্ছিল। কিন্তু সঞ্চারীর হাতটা ধরতে পারল না, বাধো বাধো ঠেকল কেন জানিনা। এতদিনের দূরত্ব দুটো এত চেনা মানুষকে দ্বিধাগ্রস্ত করে তুলেছিল। পাশাপাশি দুজনে বেরিয়ে এল ঘর থেকে, খুব কাছাকাছি দুজন, কিন্তু কারো আঙুল এগিয়ে এলোনা একে অপরকে ছুঁয়ে দেখার জন্য। কারণ আগুন ছিল দুটো মানুষের হ্রদয়ে, "পাছে যদি আবার ফিরে যেতে হয় সেই দিনগুলোতে?"। অজানা ভয় ছিল দুটো মনে।

সঞ্চারী বেসরকারি চাকরি পায়, কিন্তু অরুণ লেগে থাকে তার রাজনীতি আর মিটিং মিছিল নিয়ে। সঞ্চারীর বাড়ির থেকে প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও, প্রায় অমতে মন্দিরে গিয়ে বিয়ে করে অরুণের সাথে। কিন্তু হয়ত বিয়েটা সময়ের আগেই তাড়াহুড়োতে হয়েছিল। অরুণ বাধা দেয়নি। সংসারের দায়িত্ব নিতে এতটাও প্রস্তুত ছিল না, কিন্তু প্রেম আর বিবাহ যে দুটো ভিন্ন জিনিস সেটা পরে বুঝতে পারে দুজনে। অরুণের পরিবার বলতে বিধবা মা। বিয়ের পর, উত্তর কলকাতায় একটা ভাড়া বাড়িতে তিনজনের সংসার। অরুণ তখনও চাকরি ব্যপারটা নিয়ে মাথা ঘামায়নি, কিন্তু সংসারের জোয়াল একা সঞ্চারীর পক্ষে টানা অসম্ভব হয়ে পড়ছিল। নিজের ইগোতেও বাঁধছিল। হাজার হোক, সব মেয়েরই রোজগেরে স্বামীর একটা স্বপ্ন থাকে। কিন্তু অরুণ তখন বেশি সময় কাটিয়েছে মাঠে ময়দানে, গ্রাম থেকে মাঠে, কথা বলেছে সমাজের প্রান্তিক মানুষের কাছে। সমাজ আর রাজনীতিকে "ডাস্টবিন" বলে দূরে সরিয়ে রাখার চেয়ে, সেই সমাজকে পরিচ্ছন্ন করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এটাই একটা মুল কারণ ছিল সংসারের দিকে অরুণের অমনোযোগের। মন মালিন্যও কম হয়নি এই নিয়ে দুজনের মধ্যে, কিন্তু না অরুণ বোঝার চেষ্টা করেছে, না করেছে সঞ্চারী।একটা মানুষ সমাজের বৃহত্তর জনমানসের কথা ভেবেছে, পরিবারের কথা একবারের জন্যও না ভেবে, আরেকজন সেই মানুষটার মধ্যে সাদামাটা "চুল উল্টে আঁচড়ানও সরকারি চাকুরে বাঙালি স্বামীকে" খুঁজেছে। ঠিক একই ভাবে সেই ছেলেটা শ্রেণী সংগ্রামীর ঘরণীর মত ভেবছে সঞ্চারীকে, ভেবেছে আপদে বিপদে তাকে পাশে পাবে, মায়ের দেখাশোনা করবে। সংগ্রামীদের জীবন তো অনেকটা এই রকমই- "আমরা সংগ্রামী, আমাদের স্বপ্ন দেখবে দেশের আগামী।" তাই চেয়েছে, সঞ্চারীকে সংসারের হাল ধরতে, বা অন্য ভাষায় দিনে দিনে ছাদের কিনারায় পাখনামেলা মেয়েটার ডানায় পড়িয়েছে সংসারের শিকল। হয়তও এটাও একটা ভুল ছিল।

এভাবেই একটা সম্পর্ক "বোঝা" হয়ে যায়।

"আমার এখানকার রাস্তা ঘাট চেনা," চলতে চলতে অরুণ স্বগতোক্তি করল।

জায়গাটার নাম গড়পঞ্চকোট, পুরুলিয়া জেলার ভিতরের দিকে, একটা বেশ সুন্দর হিলটাউনের মত। গেট ছেড়ে বেড়তেই নজরে পড়ল, আঁকা বাঁকা পথ গেছে মালভূমির ঢাল বেয়ে।বেশ ঘোরানো রাস্তা, আর দুদিক থেকে হেলে আসা ঘন গাছের সারি। অন্ধকার ঘুটঘুটে রাস্তায় মাঝে মাঝে বাইকের আনাগোনা, কয়েকটা হাতে গোনা গাড়ি। বেশ কিছুটা দূরত্বের পর পর রয়েছে ল্যাম্প পোস্টের আলো। পাশ দিয়ে যাবার সময় কয়েকজন মানুষ সেলাম জানিয়ে গেল। এখানে অরুণকে সবাই চেনে। কলেজের পর, পুরুলিয়ার এই অংশে মাটি কামড়ে পড়ে থেকেছে। মানুষের সাথে মিশে গেছে নানান সামাজিক প্রকল্পে, কাজে। প্রথমে পুর প্রধানের দায়িত্ব সামলেছে, কিন্তু সেই অবস্থাতেই পদত্যাগ করে পরের নির্বাচনে হাইকমান্ডের নির্দেশে এখন স্থানীয় বিধায়ক। এখানকার "কাজের ছেলে"। রাস্তার ধার দিয়ে হাঁটার সময় হিমেল হাওয়া কাছে নিয়ে আসছিল দুজনকে। সঞ্চারীকে ঠাণ্ডায় বেশ জড়সড় ভাবে হাঁটতে দেখে, অরুণ নিজের শাল খুলে জড়িয়ে দিল ওর গায়ে।

"ইস, শালটা গায়ে দিয়ে আসতে ভুলে গেছি। একি তোমার কি হবে? এই শীতে...নানা, আমি ঠিক আছি..."

"সঞ্চারী, আমি এখানকার মাটির ছেলে, আমার অভ্যাস আছে।"

"নানা, সে কি করে হয়?"

অরুণ মনে অজান্তে ওর আঙুলগুলো চেপে ধরে অনুরোধ করে বলল, "আমার সোয়েটার আছে।বললাম তো, কিছু হবে না, এই তো আমি আছি তোমার পাশে। কাঁপুনি লাগলে টেনে নেব।"

শুনে দুজনেই বেশ খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। "এই দরজাটা তো দেওয়া হলনা..."

অরুণ হেসে বলল, "আমার আর কিছু হারাবার নেই সঞ্চারী। নিঃস্বদের আবার ভয় কিসের?" সঞ্চারী চুপ করে শুনছিল।
তারপর নীরবতা ভেঙে পথ চলতে চলতে একটা প্রান্তে থেমে দাঁড়াল।

"তুমি দাঁড়িয়ে পড়লে??"

"আচ্ছা অরুণ, তোমার কি মনে হয়, সব হারানো শুধু তোমার? আমাদের বিবাহ বিচ্ছেদের পর তোমার মনে হয়, আমি খুব সুখে আছি?"

"সঞ্চারী, আমি সরি, যদি.."

"আমাকে বলতে দাও অরুণ।" অরুণের সামনে আগুনের মত ফেটে পড়ল সঞ্চারী, "না আমাকে বলতে দাও। তোমার শুধুই মনে হয়, যে আমি আমার কেরিয়ার এর দিকে বেশি মন দিয়েছি? তোমার মনে হয়, আমি এই সম্পর্ক থেকে সরে যেতে চেয়েছি, আমার নিজের স্বপ্ন পূরণ করার জন্য? কি করে ভুলে গেলে, সেই সময়ের কথা, যেদিন তোমার রক্তে ভিজে গেছিল আমার শাড়ি, কি করে ভুলে গেলে সেই মেয়েটার কথা যে তিলেতিলে তোমাকে নিজের মত করে তোলার স্বপ্ন দেখেছে? কি করে ভুলে গেলে সেই স্ত্রীর কথা, যে আর পাঁচটা মেয়ের মত, তোমাকে নিয়ে সংসার করার স্বপ্ন দেখেছে।"

সঞ্চারীর চোখ ছলছল করছিল, ল্যাম্প পোস্টের লো-ভোল্টেজ নিয়ন আলোয় দেখা যাচ্ছিল, ওর ফোঁপানো কান্না, " কি করে এত স্বার্থপর হয়ে গেলে অরুণ?সবার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়লে, কিন্তু যে মেয়েটা তোমার জন্য সারা দুনিয়ার থেকে আলাদা হয়ে গেল, নিজের বাবা-মার ঘর ছেড়ে এল তোমার কাছে, শুধু তোমাকে পাবে বলে, তার কথা কিভাবে ভুলে গেলে?"

অরুণ কোনও কথা বলেনি, যেমন বলেনি চার বছর আগে দুই পক্ষের উপস্থিতিতে উকিলের বাড়িতে কাগজে সই করার সময়। অরুণ খুব ভালবেসেছিল ওকে, তাই হয়তও পথের কাঁটা হতে চায়নি। নিঃশব্দে সরে যেতে চেয়েছে, যাতে মেয়েটা ডানা মেলে দিতে পারে আপন স্বাধীনতায়। অনেক কৃচ্ছসাধনের মত, নিজের সম্পর্ককেও বলি দিয়েছিল মেয়েটার নিজের পায়ে দাঁড়াবার স্বপ্নের জন্য। জানতে দেয়নি সঞ্চারীকে কিছুই, শুধু মাথা পেতে মেনে নিয়েছিল, ওর সব শেষ শর্ত।

কিছুক্ষণ পর নিজেকে সংযত করল সঞ্চারী। চোখ মুছে বলল, "পরিবার শব্দটার জন্য দুটো মানুষের সমান চেষ্টা লাগে অরুণ। আমি একা পারছিলাম না, অরুণ। তোমার মায়ের অসুখ, রান্নাঘর, অফিসের কাজ- আমি পারছিলাম না। তুমি যখন দিনের পর দিন বাইরে থাকতে, একবারও মনে পড়েছে আমার কথা? এত মানুষকে ভালবাসলে, আমাকে ভালবাসতে পেরেছ?"

অরুণ ওর হাত ধরে কাছে টেনে নিল বুকের মাঝে, নিয়নের অস্ফুট আলোয়, ঘন নিঃশ্বাসের মাঝে, আলতো করে মুছিয়ে দিল গাল। আগুনের মত জ্বলতে থাকা সঞ্চারীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, "আমি যা পারিনি, সেটা তো তুমিও পূরণ করে দিতে পারতে। আমি তো সাধারণের মত সুখী হতে চাইনি। মানুষের মাঝে আমার মুক্তি খুঁজেছি। তুমি তো সব জানতে, সব জেনেই আমার সাথে ঘর বাঁধতে চেয়েছিলে। আমি তো কিছু লুকায়নি। আমি চাইনি তুমি কষ্ট পাও। আমি সব সময় চেয়েছি তুমি ভাল থাকও। তুমি চলে যাবার পরও আমার প্রার্থনা একই থেকেছে।"

সঞ্চারী বারবার বলতে চেয়েছে নিজের একলা হয়ে যাবার কথা, কিন্তু কুণ্ঠা আর লজ্জা আর যেন ওকে অবশ করে দিয়েছে। ভাল নেই সঞ্চারী। খবরের কাগজে, টিভির নিউজ চ্যানেলে যখনই কোনও খবর পেয়েছে তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে অরুণের ছবি।কখনও গর্ব হয়েছে ওর জন্য, কখনও চিন্তায় ব্যকুল হয়েছে "মানুষটার" জন্য। নিজের ডায়েরিতে জমিয়ে রেখেছে কাট আউট। অনেকবার ভেবেছে অরুণের সাথে দেখা করার, দু একবার চেষ্টাও করেছে, কিন্তু অরুণ কোলকাতায় ছিল না। ওর ফোন নাম্বার যোগাড় করেও কল করার সাহস করে উঠতে পারেনি। "যদি আমাকে অসহায় ভাবে"- এই দুশ্চিন্তা কুরেকুরে গ্রাস করেছে ওর মন।

সঞ্চারী নীরব থেকেছে, অরুণের স্পর্শ এক লহমায় ওকে ফিরিয়ে দিয়েছে সেই পুরনো দিনগুলোতে। নখের ডগায় আঁকড়ে ধরেছে অরুণের জামা, শিরায় শিরায় অনুভব করতে চেয়েছে সেই মারখাওয়া রক্তে ভিজে যাওয়া ছেলেটাকে। নিঃশ্বাসের গভীরতায় কখন যেন দুটো ঠোঁট খুব কাছাকাছি চলে এসেছিল। কিন্তু অরুণ থেমে গেছিল, কোনও অজানা অভিমানে। সঞ্চারী তাই অনেক চেয়েও পায়নি তাকে আরেকবার ছুঁতে।

বেশ খানিকক্ষণ এভাবে থাকার পর যখন দুজনেই দুজনের আকুতি বুঝতে পারল, তখন সংযত ভাবে অরুণ বলে উঠলো, "অনেক রাত হয়ে এল। ফিরতেও হবে। যাওয়া যাক। আজ একসাথে কটেজের ক্যান্টিনে খাব।আজ দেখবে মাইমার হাতের রান্না"

সঞ্চারী আরেকটু সঙ্গে থাকতে চাইছিল, কিন্তু সময় আর সংযম বাধ সাধল।

"আমি এখানে ঘরের ছেলের মত। এখানে এক বুড়ি মা থাকে, কটেজে রান্না বান্না করেন। আমি সকালে বলে রেখেছিলাম রান্নার জন্য। মা মারা যাবার পর আর কোলকাতায় যাই না খুব একটা। আমাকে এরাই সবাই মানুষ করেছে। তুমি তো আর পারলে না।"

"ধুস", সঞ্চারী অনেক ক্ষণ বাদে আবার হাসল।

একটা ছোট্ট ক্যান্টিনের ঘর, টিমটিমে আলো, অজস্র বয়স রেখায় জীর্ণ তার মুখ। সাদা থানের কাপড়, আর মিশ কালো রং। টেবিল পেতে বসে পড়ল দুজন, বুড়ি মা খেতে দিল। ভাবনারও অতীত যে একজন বিধায়ক এভাবে মাটির কাছাকাছি বসে বুড়িমার রান্না খাবে। "তোমার সিকিউরিটি গার্ডরা সব কোথায় বলতও?"

অরুণ একগাল হেসে বলল, "ধুস, সব বেকার। আমি রতনকে বলে দিয়েছি, এই কয়েকটা দিন আমার আশে পাশে কেউ যেন না থাকে। তাতেও কি শান্তি হয়। হাজার বার ফোন। আমি বন্ধ করে দিই মাঝে মাঝে। অনেক কষ্টে শিষ্টে এই "একলা" সময় বার করতে পেরেছি। গাড়িটা সঙ্গে নিয়ে এসেছি, এদিক সেদিক দরকার পড়লে। কিন্তু এই সব জায়গা, আমার হাঁটা পথে ঘোরা। বুড়ি মা, আমাকে চেনে অনেক দিন।"

"কিরে খোকা, এইটা কে?" বুড়ি মা একগাল হেসে গদ গদ ভাবে শুধলও।

অরুণ সঞ্চারীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, "আমার বউ"।

"কই বলিস নিতো আগে যে বে করেছিস?আর তাহলে পোলা পান কয়ডা?"

"বুড়ি মা, বড্ড খিদে লেগেছে, দাও তো দেখি, আবার কটেজে ফিরব।" অরুণ কথাটা এড়িয়ে গেল খুব সন্তর্পণে। অল্প রান্না, বেশ পরিপাটি করে খেয়ে, প্রণাম জানিয়ে বেরিয়ে পড়ল ফিরতি পথে।ক্যান্টিনের বাড়িটা থেকে কটেজগুলো বেশ খানিকটা ভেতরে।

ফেরার সময় দুজনে আর কোনও কথা বলেনি। নীরবে হাঁটতে হাঁটতে অনুভব করেছে, দুজনের অজান্তে অপরিচিত হয়ে যাবার গল্প। কখনও মনে পড়েছে এক সাথে ময়দানের দুপুর, কিম্বা আহিরিটলা ঘাটের জেটিতে বসে নীরব সন্ধ্যে বেলা, অথবা বৃষ্টির দিনে প্রথমবার...... "সে জানে আমার প্রথম সব কিছু।" অনুভব করেছে নিজেদের ছোট ছোট ভুলগুলো। কখনও অনুতাপ, কখনও আক্ষেপ ধরা দিয়েছে মনে। আবার কখনও মন ব্যকুল হয়েছে এই কথা ভেবে, "এই অকস্মাৎ সাক্ষাতের পর কি হবে, আদৌ কি সব কিছু আবার আগের মত......নাকি এসবই শুধু ক্ষণিকের আবেগ?"

সঞ্চারীকে কটেজের দরজা অবধি এগিয়ে দিয়ে ফিরে চলে গেছে, অরুণ। এক মুহূর্তের জন্যও দাঁড়ায়নি। নিকষ অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে দেখেছে ওকে।

আলো নিভিয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে ভেবেছে অরুণের কথা। অনেক রাত অবধি অরুণের ঘরে আলো জ্বলছিল। হাপুসভাবে জানালার ফাঁক দিয়ে চেয়ে থেকেছে ওর ঘরের দিকে। দুজনে তো একসাথে ঘর বাঁধতে চেয়েছিল, তাহলে আজ এমন পরিস্থিতির জন্য কে দায়ী?

পরদিন সকালে বেশ বেলা হয়ে গেছিল উঠতে সঞ্চারীর। অ্যালার্ম দিতে ভুলে গেছিল আগের রাতে। খেয়াল হল, অরুণের দেওয়া শালটাই জড়িয়ে ঘুমিয়ে গেছিল ক্লান্ত বিছানায়। সারাটা রাত, ওর শরীরের গন্ধ জড়িয়ে রেখেছিল সঞ্চারীর মন। উঠে মোবাইল চেক করতেই দেখল, ফেসবুকের একটা আপডেট। আজ অরুণের জন্মদিন- সৌজন্যে ফেসবুক। বিয়ের বছর গুলোর পরে কখনও আর উইশ করেনি- বলা উচিত প্রতিবার আঙুল থেমে গেছে। কিন্তু এইবার? এইবার তো মানুষটা পাশের ঘরেই? তড়িঘড়ি উঠে পড়ল বিছানা ছেড়ে, আর যাই হোক, টান টা তো রয়েই গেছিল মনে। স্নান সেরে, একটু হাল্কা সাজগোজ। কিটস ব্যাগ থেকে দুটো নতুন শাড়ি বার করে বিছানায় রাখল। বুঝে উঠতে পারছিল না কোনটা পড়বে। অবশেষে গত পুজোতে মায়ের দেওয়া শাড়িটা জড়িয়ে নিয়ে দাঁড়াল আয়নার সামনে। সিঁদুরের দাগটা এখনও রয়ে গেছে কপালে, এই দাগ যে বড়ই কঠিন। আয়না থেকে টিপটা নিয়ে লাজুক ভাবে কপালের মাঝে বসাল। অরুণের শালটা গায়ে দিয়ে ধীরে ধীরে কটেজের কাছে এসে দেখল, তালা। গেট কিপার জানালো "এম এল এ সাহাব, বহত সাবেরে সাবেরে নিকাল গায়ে। উও তো চালে গায়ে ম্যাডাম।"

একটু মনক্ষুণ্ণ হল, ধীর পায়ে ফিরে এল নিজের কটেজে, স্থবিরের মত বসে পড়ল বিছানার ওপর। বারবার অস্ফুট স্বরে বলতে থাকল, "চলে গেল..."। অরুণের স্মৃতি বলতে রয়ে গেছিল সেই শাল, যা তখনও তাকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রেখেছিল। সেটাকে আঁকড়ে ধরে অনেকক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে আয়নার দিকে তাকিয়েছিল সঞ্চারী, কিছু বলতে পারেনি, শুধু গুমরে উঠেছিল কষ্টে। যেমন হয়েছিল অরুণের ভোরবেলা লোকচক্ষুর আড়ালে কুয়াশার মাঝে মিলিয়ে যাবার সময়। গেটের কাছে এসে থমকে দাঁড়িয়েছিল সঞ্চারীর কটেজের দিকে তাকিয়ে, পর্দাটা অনেকক্ষণ লক্ষ্য করেছিল, বার বার মনে হয়েছিল, "যদি ও একবার পর্দা সরিয়ে দেখে। শুধু একবার বলুক থেমে যেতে..."। কিন্তু এমনটা হয়নি। আর্দ্র চোখে মুখ নামিয়ে বিদায় নিয়েছিল। বলতে চেয়েছিল অনেক কিছু, কিন্তু পারেনি। কিছু জিনিস গল্পের মত হলে ভাল হত, কিন্তু বাস্তব হয়ত অনেকটাই কঠিন।

সঞ্চারী কোলকাতায় ফিরতে পাশের বাড়ির কাকিমা বলল, "এই তোমাদের লেটার বক্সে আর জায়গা নেই। তাই আমাদের বাড়ি পিওন চিঠি রেখে গেছে।"

"চিঠি?", সঞ্চারীর কেমন একটা খটকা লাগল।

ছুটে গেল ডাকবাক্সের দিকে, খুলে দেখল অনেক গুলো চিঠি। আজ ইন্টারনেটের যুগে সমস্ত কাজ তো এসএমএস আর এমেলেই হয়। চিঠি তো প্রায়...অবলুপ্ত হবার পথে। তাহলে এগুলো লিখল কে?

কোনোটা ৩রা জানুয়ারি, ২০১১; কোনোটা ১৪ই জুন, ২০১২, কোনোটা ৮ই এপ্রিল, ২০১২ -এমন অনেক চিঠি সারি সারি বিভিন্ন মাসে বিভিন্ন সময়ে এসেছে, কিন্তু কোনোদিন কেউ খেয়ালও করেনি। খুলেও দেখেনি ডাকবাক্স।সঞ্চারী মুখ চেপে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল, যখন দেখল, সব কটাই অরুণের লেখা। সম্পর্ক টাকে এত বছরেও সরু সুতোর আলম্বে ধরে রেখেছিল সেই ছেলেটা এতদিন পরেও, সঞ্চারী কোনোদিন টেরও পায়নি। রুদ্ধশ্বাসে সিঁড়ি দিয়ে উপরের ঘরে গিয়ে দরজা বন্দ করে দিয়েছিল।
"এই সঞ্চারী? কি হয়েছে তোর?", ওর মা তখন বারবার দরজা ধাক্কা দিচ্ছে উদ্বেগে।

"তুমি চলে যাও, আমাকে একটু একলা থাকতে দাও। আমি ভাল আছি। আমি খুব ভাল আছি।"

ছলছল চোখে, একের পর এক খাম ছিঁড়ে ফেলেছে, লাইনে লাইনে খুঁজে পেয়েছে অরুণের গল্প। সে ছেলেটার প্রেমিক হয়ে অথার গল্প। কখনও কবিতা, কখনও গান, কখনও নেহাত মনের কথা-ডিভোর্সের পরও অরুণ চিঠি লিখে গেছে প্রতি মাসে, যেমন লিখত আগে কলেজের সময়। সঞ্চারীর মনে পড়ে যাচ্ছিল সেই সন্ধ্যে বেলায় অরুণের সেই "চিঠি লেখার অভ্যাসের কথা"।

সঞ্চারী শুধু একা ওকে ফিরে পেতে চায়নি, আরেকটা মানুষও দূরত্বের আড়ালে ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করেছে ওর জন্য, হয়ত আজও করে আছে...

ধন্যবাদান্তে,
সম্পাদক-নবপত্রিকা

2 comments:

  1. অনবদ্য অসাধারণ খুব সুন্দর। মনটা যদিও ভারী হয়ে গেল কিন্তু খুব ভাল লাগলো ।

    ReplyDelete
  2. অনবদ্য অসাধারণ খুব সুন্দর। মনটা যদিও ভারী হয়ে গেল কিন্তু খুব ভাল লাগলো ।

    ReplyDelete