রান্নাঘরে তখন ভীষণ ব্যস্ততা। ঘুলঘুলি দিয়ে হেলানো রোদ্দুর এসে পড়ছে লাল রঙের মেঝের ওপর। তার ছায়াগুলো যেন একে দিয়েছে আলপনা মেঝের ওপর। দুপুর রৌদ্রে প্রায় ঘেমে স্নান করে ফিরেছে একটু আগে, অভীক। বর্ষাকালের শুরু হয়ে গেলেও গরম এখনও যায়নি। রোদ একবার উঠলে রক্ষে নেই। ফ্ল্যাটের চাবি সঙ্গেই ছিল। তাই কাউকে ডাকতে হয়নি উপর থেকে চাবির গোছা ফেলার জন্য, সোজা চলে এসেছিল ঘরে। এই পাড়াটা বেশ নিরিবিলি- অত শব্দ নেই। বিয়ের পর এই ফ্লাটটাতেই একটা ছোট্ট সংসার নিয়ে চলে এসেছিল, রাইটার্সে বদলি হবার পর। তাই দুপুরগুলো বেশ নিঝুম হয়। আর গরমেও লোক রাস্তায় ভীষণই কমে গেছে। মাঝে মাঝে এক দুটো সাইকেলের ক্রিং, বা স্কুল ফেরত কিছু ছানাপোনার ছটফটানি। তবে আজ এসবের শব্দটাও উধাও। রবিবার। একটু চোখে মুখে জল দিয়েই এসে বসল বেডরুমে, আর মালতীর উদ্দেশ্যে বলল, "তুমি আর একটু বসও। আমি সব সামলে নেব। তোমাকে আগেই বলেছি, আজ আমি রান্না করব তোমার জন্য। তাই বাজার থেকে......" কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গেল অভীক আর মুচকি হেসে আবার তাকিয়ে বলল, "নাহ এখন বলব না তোমায়। যখন খেতে বসব দুজনে তখন বুঝতে পারবে। তবে এটুকু বলছি, তোমার মনের মতো জিনিস এনেছি।"
কপাল দিয়ে যখন ঘাম নেমে আসছিল ক্ষুদ্র স্রোতস্বিনী হয়ে, তখন আবার একটু গামছা দিয়ে মুছে বলল, "আমি জানি, তুমি মানা করছিলে কাল, কিন্তু আমি কি আর থোড়াই তোমার কথা শুনব? আজ তোমায় দেখাব, চাকরির পোস্টিঙে থাকার সময় আমিও কিছু কম রান্না শিখিনি।"
তারপরই পিছন ফিরে মালতীকে বলল, "দেখও। এত চুপচাপ থাকলে ভাল না। ঠিক আছে, ঝগড়া করব, কিন্তু আজকের দিনে নয়। লক্ষ্মীটি আমার। আর হ্যাঁ, গতবারে মাংসের কারি তে একটুই নুন কম হয়েছিল। সেই জন্য আজ অবধি গোসা করে থেকো না। কেমন?"
মালতীর নীরবতায় ছিল একটা প্রছন্ন সম্মতি। নিজের প্রিয় স্ত্রীর জন্য অভীক খুব চেষ্টা করে তাকে মানানোর। দু'দিন আগেই গুছিয়ে ঝগড়া করেছে। এই "গুছিয়ে" শব্দটা গুছিয়ে না বললে বোঝানো অসম্ভব এই দুই মানুষের ভালোবাসা। দুজনেই ভীষণ রেগে যায় যখন ঝগড়া করে, তবে মালতী অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি সহনশীল এই ব্যাপারে।যদিও শেষ কথা অভীকই বলে আর মালতী সম্মতি না দিয়ে পারে না। অনেক সময় এমনও হয়েছে, দুজনে মিলে "ঠিক" করেছে আজ ঝগড়া করবে। তার জন্য মুড়ি মাখা নিয়ে বসে দুজনে তর্ক করেছে, আর সব শেষে দুজনে হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়েছে একে অন্যের ছেলেমানুষি দেখে। অনেক সময় দ্বন্দও হয়েছে। সংসারের থালাবাসনের ঠোকাঠুকি থাকবেই। মালতী অনেক সময়েই বকা খেত ঠিক মতো ওষুধ না খাওার জন্য। আবার মালতীও খুব অভিমান করত যখন অনেক ক্ষণ অপেক্ষা করেও পেত না অভীকের মোবাইল মেসেজ। দুজনের এমন অভিমান যেন হয়তও এই রাতের পর আর মুখ দেখাদেখি হবে না। তারপর আবার মিল, যখন মাঝরাতে মালতীকে টেনে তুলেছিল ঘুম থেকে আর বলেছিল ফিসফিস করে , "মালতী?এই আইসক্রিম খাবি?" অভীক আর মালতী কলেজের বন্ধু। তাই যখন খুব রোম্যান্টিক হয়ে যায়, তখন তুই-তো-কারি করে কথা বলে। অভীক এই ব্যাপারে ভীষণ সচেতন। সে ভালও মতো জানে "তুই" এর অর্থ- স্ত্রী হিসাবে মালতী রাগ করলেও বন্ধু হিসাবে বেশি ক্ষণ অমান্য করতে পারবে না। তাই মানানোর এটাই সহজ পন্থা।
আজ অভীক একটু বেশি ততপর, কারণ বেলা হয়ে গেছে একেই। আর দেরি করা যাবে না। তার আগে অবশ্য বাজারের থলি থেকে জিনিসগুলো ফ্রিজে সাজিয়ে নিয়েছে। আজ বাজারে অনেকটা সময় লেগে গেছে দরদাম করতে গিয়ে; পোনা মাছের দামটা ইদানীং একটু চড়া আছে। কিন্তু তাতে কি? মেছোর সাথে এতদিনের আলাপ আর কখন কাজে আসবে? "ইস, মালতীর খুব খিদে পেয়ে যাবে", একবার মনে মনে ভাবল। মনে পড়ছিল কলেজের দিনগুলো। মালতী একটুও খিদে সহ্য করতে পারে না। সাধারণত মেয়েরা খাওয়ার ব্যাপারে একটু লাজুক হয়, সহজে বলে না। অর্ধেক খেয়েই বলে "আর পারবও না"। কিন্তু অভীকের জেদে সে নিজেকে পাল্টে নিয়েছিল। আর খিদে পেলে অভীককে অসঙ্কোচে বলে দিত। "এই তুই বিস্কুটের প্যাকেট টা কোথায় রেখেছিস? ক্রিম বিস্কুট গুলো দে না। বড্ড কিদে পেয়েছে"। অভীক একটুও শান্ত থাকতে পারে না, যখন সেই "মেয়েটা" এমন লাজুক আবদার করে। দিশেহারা হয়ে যায়, যদি না কিছু থাকে সঙ্গে। আজকেও তাই একটু শশব্যস্ত হয়েই বাজারের জিনিসগুলো ভাল করে গুছিয়ে নিচ্ছিল। "ওর খিদে পেয়ে গেলে আমার কষ্ট লাগবে", তাই একটু ক্ষণিকের বিশ্রাম নিয়েই চোখ মুখ মুছে কাঁধে একটা টাওএল ঝুলিয়ে চলে এলো রান্নাঘরে। আজ রবিবার বলে কথা, তাই ভাল মন্দ একটু রান্না হওয়া চাই দুই' জনের ছোট্ট সংসারে।
"প্রথম পাতে আজ একটু উচ্ছে ভাজা, আর পিয়াজকালি করি কেমন?আর তোমায় অত গিন্নিপনা আজ করতে হবে না কিন্তু। আমি সব পারব। আর ছেঁকাও লাগবে না। তুমি চুপটি করে বসে থাকও। আজ তোমার রেস্ট।" এই কথাটা বলে স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে অভীক রান্না ঘরের দখল নিয়ে নিল। পিঁয়াজের ঝাঁজে তখন অভীকের অবস্থা কাহিল। চোখ দিয়ে অনর্গল জল পড়ে যাচ্ছে, গাল বেয়ে। খানিক বাদে ভেতরের ঘরে মালতীর দিকে চেয়ে বলল, "দেখছ তো? তোমার সাথে ঝগড়া করার ফল? আমি না চাইলেও দেখ কেমন কাঁদছি"।
প্রথম পাতের ভাজা চাপিয়ে, মাছ ধুতে বসল ওর দিকে তাকিয়ে বলল, "শুনছ মালতী, আজ মাছটা একটু বেশি দাম দিয়েই কিনলাম। ও বাজারে যেতে পারতাম, কিন্তু আর দেরি করলাম। বেলা হয়ে গেছিল। "অভীকের চোখে মুখে অদ্ভুত একটা তৃপ্তি- তবে এর পেছনে একটা অন্য কারণ ও আছে। সেটা......
অভীক মামার বাড়িতে মানুষ হয়েছে। কোনোদিনও মাতৃ স্নেহ পায়নি। মালতী তাই ভীষণ খেয়াল রাখত। কথায় আছে, একটা মেয়ের মধ্যে নাকি স্ত্রী, বোন, দিদি, মা, বন্ধু সব কিছু মিশে থাকে। মালতী কেমন যেন স্নেহে আগলে রাখত অভীককে। অফিস যাবার আগে জামার বোতাম লাগিয়ে দেওয়া, ওর পড়ার টেবিলে সুন্দর করে ডায়েরি গুছিয়ে রাখা, স্নান করে আসার পর জোর করে ওর হাত থেকে টাওএল কেড়ে নিয়ে বলা "দাড়াও, তোমার দ্বারা হবে না। এইভাবে মাথা মুছলে দুদিনে সর্দি লাগবে। আমি মুছিয়ে দিচ্ছি", কখনও টিফিন বক্সে খাবার রাখার সময় রেখে দিত একটা চিরকুট একটা বাটিতে যাতে লেখা "আমার কথা মনে পড়লে, একবার............", কখনও আবার রাত্রি বেলা অভীক ক্লান্ত হয়ে পড়লে জেদ করে বন্ধ করে দিত ল্যাপটপ আর বলত, "আমার কোলে মাথা রেখে দাও, আর ঘুমিয়ে পড়"- অনেক গভীর রাত অবধি মাথায় হাত বুলিয়ে যেত আদর করে আর দেখত ওর ঘুমে জুড়ে আসা ঠোঁট।
কড়াই এর ধোঁয়ায় প্রায় কাশি এসে গেছিল, কিন্তু অভীক মুখ ফিরিয়ে নিল সন্তর্পণে। পাছে যদি মালতী দেখতে পায়, এখুনি এসে হাতের খুন্তি কেড়ে নিয়ে বলবে, "অনেক হয়েছে তোমার ছেলেমানুষি। এবার সরে যাও। আমাকে দেখে নিতে দাও। মানে দিন দিন কি, প্রেম বেড়ে যাচ্ছে?" অভীক হেসেই ফেলল। মালতীর দিকে একবার মুখ ফিরিয়ে বলল, "আজ কিন্তু তুমি তারিফ না করে পারবে না। কি? হুম? মুচকি মুচকি হাসছ যে?"
খানিক বাদে অভীক কেমন যেন একটু এলোমেলো হয়ে গেল। রান্নার আঁচ কমিয়ে দিল, মনে হয় কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করছে। খানিক ক্ষণ ভেবে বলল, "এই মালতী? একবার শোনও না। বলছি হলুদ মশলার ডিবে টা খুঁজে পাচ্ছি না, কি করি?"
অভীকের ভুলো মন, নিজের কাছের জিনিস হারিয়ে ফেলে। ভীষণ অগোছালো। তাই কিছু হারালেই অভীকের একমাত্র ভরসা তার "প্রেয়সী"। আর এর জন্য কম বকা খায়নি তার কাছে। কিছু হারালেই একটু চুপ করে মালতীর পাশে এসে বলত, "তোমার কানের দুলটা খুব সুন্দর লাগছে"। মালতী বলত, "হুম। আজ মনে হচ্ছে অফিস যাবার ইচ্ছে নেই। কি ব্যাপার রায় মশাই? আজ যে বড় আমার খবর নেওয়া হচ্ছে?" অভীক ঢোঁক গিলে বলত, "কি বলছ? আমি রোম্যান্টিক নই? তোমার কানের দুলটা দেখে ভাল লাগল, তাই। কবে কিনলে গো?"
"দু'বছর হয়ে গেল। আজ খেয়াল পড়েছে? আচ্ছা, কিছু হারিয়েছ?"
"কই না তো? এমনিই......" কথাটা বলেও অভীক থেমে যেত। লুকিয়ে যেত। চলে যাবার আগে মালতী হাত টেনে ধরে বলত, "বেডরুমে সব আলমারি টেনে নামিয়েছ দেখলাম। কি খুঁজছ বলতো?"
"না মানে, তোমার জন্য একটা নতুন শাড়ি এনেছিলাম কাল। কিন্তু দিতে......"
"ওইটা এখনও তোমার ব্যাগেই আছে। দেখো গে"
অভীকের মনে পড়তেই সেই খুশি খুশি ভিতরের ঘরে যেতে গিয়েও থমকে গিয়ে বলত, "তুমি কি করে জানলে?" আর হেসে ফেলত ওর চোখের দিকে তাকিয়ে।
সব রান্না শেষ করে যখন টেবিলে খাবার সাজাল তখন মালতীকে বলল, "একটু অপেক্ষা কর। আমি একটু স্নান করে নি, কেমন?"
একদম পরিস্কার হয়ে এল বেডরুমে। আলমারি থেকে নতুন জামা বার করে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। এই জামাটা কিছুদিন আগেই কিনেছে। মালতীর খুব প্রিয় রং সবুজ। তাই এই নতুন জামাটা তার ইচ্ছেতে কেনা। আয়নাতে বারবার নিজেকে দেখছে আর তৃপ্তি পাচ্ছে মনে মনে। মনে মনে মালতীর জন্য হাসছে, আদর করছে- ওর পছন্দের জন্য। এরপর, এসে বসল খাবার টেবিলে। "জামাটা ভাল? হ্যাঁ? দেখো আজকের জন্য কিনেছি। ও হ্যাঁ, তোমার নতুন শাড়িটা কিন্তু আমার আলমারিতে রাখা আছে। আজ আমরা দুজনে এক থালায় খাব"। খুব আদর করে এক থালায় সব তরকারি মাছ- ভাত সাজিয়ে নিল। তারপর
একটু ভাত মাছ দিয়ে মেখে হাতে নিয়ে বলল, "কি মালতী, আমার হাতে থেকে খাবে না?"
একটু ভাত মাছ দিয়ে মেখে হাতে নিয়ে বলল, "কি মালতী, আমার হাতে থেকে খাবে না?"
কথাটা বলার সাথে সাথেই অভীক কেমন যেন হারিয়ে গেল, কাঁপতে থাকল ঠোঁট যখন সে ভীষণ অভিমানে বলল, " আজ আমাদের বিবাহ বার্ষিকী। আজকের দিনেও রাগ করে বসে থাকবে?"
চোখ ছলছল করছে অভীকের যখন সে ভারি হয়ে আসা গলায় বলেছে, "এত বছর ধরে প্রতিদিন রান্না করছি তোমার জন্য, কই একদিনও খেতে ইচ্ছে হল না আমার হাত থেকে?এত রাগ করেছ যখন কেন ভালবেসেছিলে আমায়? হুম? একবারও মনে হয়না আমার কথা শুনতে?একটি বার খাও লক্ষ্মীটি......" - তার সামনে তখন ফাঁকা সেই চেয়ার, যেখানে একসময় মালতী বসে খাইয়ে দেবার আবদার করত। তিন বছর আগে দুরারোগ্য এক ব্যাধিতে......... অভীক খেতে পারছে না প্রথম গ্রাস, তার হাত কাঁপছে। ঠোঁটের কাছে এসেও খাবার ইচ্ছে যেন ভুলে যাচ্ছে। অভীক.........
অভীক আজও ভুলতে পারেনি তার প্রেয়সী কে, নিয়ম করে রোজ করেছে খাবার অনুরোধ, কিন্তু সেই মেয়েটা কবে যেন হারিয়ে গেছে স্মৃতির কিনারে। আসলে মানুষ হারিয়ে যায়, কিন্তু রেখে যায় একরাশ স্মৃতি। হয়তও এই স্মৃতি গুলোই অভীক কে আরও বেঁচে থাকার ইচ্ছে দেয়, আরও বেশি করে প্রেমিক করে তোলে। কেউ বলে পাগলামি, কেউ বলে "নিরন্তর ভালোবাসা"।
ধন্যবাদান্তে,
সম্পাদক-নবপত্রিকা
সম্পাদক-নবপত্রিকা
No comments:
Post a Comment