এবার গল্পটা আরেকটু এগোনো যাক। আমরা আবিরকে চিনেছি। আমরা চিনব আরেক মানুষকে। আমাদেরই মাঝে মিশে আছে, হয়ত আমাদের মধ্যে থেকেই বেছে নেওয়া আরও একটা চরিত্র। হ্যাঁ, তবে কাল্পনিক নয়। নিতান্ত বাস্তব। হয়ত তার সাথে মিল খুঁজে পাবেন আপনার, বা আপনার কোনও জানা পরিচিতের। "কেমন আছো তুমি?" এই প্রশ্নটা যতটাই ছোট হোক না কেন, উত্তর তার চেয়ে অনেকটাই বড়। আর যেদিন কেউ সেই উত্তরের খোঁজে বেরিয়ে পরে, সেদিন তার জীবনের গড্ডালিকা প্রবাহও থেমে যায়। সময় বয়ে চলে অন্য স্রোতে, অন্য ভাবে। আপনিও কি অনামিকার মত ভাবেন? ও হ্যাঁ। অনামিকা, বছর আঠাশের তরুণী। বিয়ের কথা চলছে। গত মাসের সাত তারিখ ছেলের বাড়ি থেকে লোক এসে দেখে গেছে। বলা উচিত "পছন্দ" করে গেছে। হয়ত আমাদের সমাজ মেয়েদের এখনও "পণ্যের" মত ভাবে। নাহলে "পছন্দের" মত শব্দ ব্যবহার করা হতো না।
সেদিনও রোদ্দুর ছিল।বাড়িতে অনেক লোকের আনাগোনা। মিষ্টিমুখ। পুরনো বাড়ির ওপর তলার আলদা একটা ঘরে, কিছুক্ষণ কথা বলার পর ছেলে ও মেয়ের মতামত নেওয়া হয়। কিন্তু আজও অনামিকার কিছু মনে পরে না, কেনই বা সে "হ্যাঁ" বলেছিল। বা আদৌ কি বলার সুযোগ পেয়েছিল? নাকি বাবা মায়ের চাপে বলতে বাধ্য হয়েছিল। কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে হঠাৎ সবকিছু তাড়াতাড়ি ঘটে গেল। যেন হঠাৎ দুটো মানুষকে একসাথে করার বন্দোবস্ত শুরু হল। প্রথমে ফোনে কথা, পরে এসএমএস, চ্যাট, ফেসবুক ও ঘনিষ্ঠতা। সব কিছু যেন নিয়ম মেনে ঘটে চলেছিল একের পর এক। আর অনামিকা কোথাও থামার সুযোগ পাচ্ছিল না। কেন ঘটছে এসব- কোনও জীবনের যোগ পাচ্ছিল না। শুধু কয়েকটা কথা যেটা মনে পড়ছিল-যে তাকে এগুলো রোজ করে যেতে হবে। রোজ সকালে ফোনে কথা বলতে হবে। দুপুরে আবার আরও কথা। বিকেলে এসএমএস অথবা কোথাও দেখা করা। রাতের দিকে চ্যাট। আদৌ বোঝা দায় ছিল, অনামিকার তাতে সত্যিই কোনও সায় ছিল কিনা।
রাগ হচ্ছিল, অভিমানে লাল ছিল ওর চোখ। ওর কথা হয়ত কেউ বুঝতে চায়না। অনেকবার মাকে বলতে চেয়েছে সেই কথা, কিন্তু ধমক ছাড়া কিছুই কপালে জোটেনই। "বাবা অসুস্থ, কন্যা দায়গ্রস্ত, এই বয়সে মন মর্জি মত যদি সব কিছু করতে চাও, করতে পার। আমি রুখব না। কিন্তু মনে রেখো, যারা ভালবেসে বড় করেছে, তাদেরকে কষ্ট দিয়ে কেউ সুখী হতে পারেনা। আমরা তোমার ভালো বুঝি। তাই আমাদের দায়িত্ব আমাদের পালন করতে দাও ", মা বলল। এর পরেও আর কিছু থাকতে পারে অনামিকার? সময়ের ধুলো জমে যাচ্ছিল মনের মধ্যে।
"ভালোবাসা"। হ্যাঁ, মা বাবাকে ভালোবাসার প্রতিদান তাকে দিতে হবে। অনামিকার সব কিছু যেন গুলিয়ে যাচ্ছিল। বুঝতে পারছিল না যে কেনই বা এই বেষ্টনী তার ভালো লাগছিল না? তার জীবনে প্রেমিক আসেনি বলা ভুল, কিন্তু তারাও কেউ আজ আর নেই। "সিঙ্গল"। তাহলে এই বিরোধের কারণ কি? যার সাথে বিয়ে হবার কথা সেও তো ভালো মানুষ। ভাল চাকরি, বড় বাড়ি। হয়ত সব কিছু করবে তার জন্য। তাহলে অভাবটা কি?
আর সেই দিনটা এল , যেদিন সকালে উঠে অনামিকা আয়নার সামনে দাঁড়ালো। হ্যাঁ! সাহস করে প্রশ্ন করল "কেমন আছ তুমি"... নাহ! অনামিকা ভালো ছিল না। সব কিছু থেকেও যেন জীবনের কিছু একটা খামতি থেকে যাচ্ছিল।ছুটে গেল উপরের ছাদের ঘরে। পুরনো বাক্সটা ধুলো ঝেড়ে নামাল।
সেদিন বৃষ্টি ঝমঝম সকাল থেকে। কিন্তু তাকে রোখার সাধ্য কার। "আজ বাঁধন ছুটেছে তার মনে"। খুলে বার করল সেই পুরনো ডায়েরি। প্রায় দু'বছর হল কবিতা-প্রবন্ধ লেখা বন্ধ হয়েছে। আগে লেখার সময় হতো। ইচ্ছে জাগত। কিন্তু ধীরে ধীরে সব যেন চলে গেছে। পাতা উল্টে পড়তে লাগল সেই পুরনো লাইনগুলো। ঠোঁটের পরতে পরতে শব্দগুলো ছুঁয়ে যাচ্ছিল তার মন। হ্যাঁ! একটা সময় ছিল যখন এমন অনেক আনমনা দুপুর কেটেছে বালিশে মাথা রেখে, আর কলম নিয়ে কাগজে আঁকিবুঁকি কথা লিখে। কখনও বোঝেনি যে কখন তা কবিতা হয়ে গেছিল। কিন্তু শেষ দু'বছরে- যেদিন সে বুঝতে পারল তার "বয়স" হয়ে যাছে বিয়ের জন্য, যেদিন থেকে "দেখাশোনার" বহর বাড়ল, গান গাওয়া পাখি আর এল না চিলেকোঠার ছাদে। আর সুর এল না অনামিকার ঠোঁটে। জীবনের প্রতি প্রেম শেষ হয়ে গেল।
অনামিকা চেয়েছে অনেকবার বন্ধুদের সাথে এই নিয়ে কথা বলতে। কিন্তু ওই যে বললাম, "এই ভাল আছি রে" এর বেশি কোনওদিন বলতে পারেনি অনামিকা। লজ্জা, কুণ্ঠাবোধ।
স্নান করে বেরিয়ে পড়ল। কাঁধের ব্যাগে সেই ডায়েরি। তা হঠাৎ ডায়েরি এই বৃষ্টি কোথায় চলল সে? "কোথায় যাচ্ছিস এখন? এই বৃষ্টি...", মা জিজ্ঞেস করল। "এই বন্ধুর বাড়ি।" আসলে আবার সে খুঁজতে বেরিয়েছিল তার জীবনকে। যে কবিতা একদিন বৃষ্টির মত কল্পনা হয়ে নেমে এসেছিল, তাদের নিয়ে আবার সে বেরিয়েছিল নতুন ভাবনার খোঁজে। আবার লিখতে হবে। হয়ত নেহাত পাগলামি। কিন্তু চেষ্টা করতে ক্ষতি কি? বাড়ির মধ্যে দম বন্ধ হয়ে আসছিল। বাগবাজার ঘাট, মায়ের বাড়ি, অথবা প্রিন্সেপ ঘাটের বাগান। যতই বৃষ্টি হোক, আজ যাবই। একলা। ফোন রেখে গেল টেবিলে।
না! বরানগর থেকে আসার সময় তবে মাঝ রাস্তাতেই থামতে হল, শ্যামবাজার মোড়ে। জল থই থই। আর তারই মাঝে একজন হঠাৎ ধরিয়ে দিল ব্যাগ আর বলল "আসছি"। আর কেউ না "আবির"। অচেনা একটা মানুষ, কিন্তু হয়ত ওর মতই ভেবেছিলো। অনামিকা পারেনি বৃষ্টিতে ভিজতে। আবির পেরেছিল।
হয়ত এটাই ছিল আবার নতুন করে শুরু করার সময়। দুজনের জন্য।
(ক্রমশ প্রকাশ্য, পড়তে থাকুন। পরবর্তী অংশ পরের প্রকাশনায়।)
ধন্যবাদান্তে,
সম্পাদক-নবপত্রিকা
সম্পাদক-নবপত্রিকা
No comments:
Post a Comment