সকালের ব্যস্ত শহর। তবে সেই ব্যস্ততার ছায়া এসে পড়েছে এই ছোট্ট মেসেও। কোনও রকমে গামছা জড়িয়ে কিছু একটা ঠাকুর নাম জপ করতে করতে বিকাশ ঘরে এলো। ওকে দেখেই ওর বাকি দুই বন্ধু, যারা তখনও মোটামুটি বিছানায় "আর উঠবো না কোনওদিন" -ভাব দেখিয়ে লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, মন্তব্য করল "শালা, তোর রোজ রোজ এই ন্যাকামো না করলেই নয়? ভাই সক্কাল সক্কাল এতো অফিস যাবার তাড়া কিসের থাকে বলতো? আমরা তিনজন তো একই অফিসে বসি ভাই, কই আমাদের প্রোজেক্টে তো এমন হাল নয়!" শ্যামল কম্বলের তলা থেকে ফিক করে হেসে বলল "বুঝলি না? সকাল সকাল ঝাড়ু মারতে যায়।"
কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়ার মূল কারণ ঘরের আলো। রীতিমতো আলো জ্বেলে, জানলা খুলে বন্ধুদের অতিষ্ঠ করে রাখে বিকাশ। "ভাই, সকালবেলা অফিস গেলে মন ভালো থাকে। শুনেই বেশ চাঙ্গা অনুভব হয়।" মোটামুটি বাঁকা সুরে অসীম বলে উঠল "মন ভালো? ভাই সকালে অন্য কোথাও ডিউটি দিচ্ছিস ভাই? নাকি নারী সংক্রান্ত চক্কর? বলতো ভাই খোলসা করে?" বিকাশ কিচ্ছু রা কাটে না। শুধু আয়নায় অতি যত্ন সহকারে চুল আঁচড়াতে থাকে, সঙ্গে জামার বোতাম লাগাতে লাগাতে। খানিক বাদে মুখ
ফিরিয়ে দুই বন্ধুর, লেপের মধ্যে থেকে অল্প বেড়িয়ে থাকা মুখের দিকে তাকিয়ে বলে "ভাই, আমার মতো মোটা মানুষের আবার নারী সংসর্গ? বলিসও ভাই...দিনের শুরুতে এভাবে মেজাজ খারাপ করাবি না। এমনিতেই সবাই দেখলে দূর থেকে পালায়, তার ওপর তোরাও যদি..."
ফিরিয়ে দুই বন্ধুর, লেপের মধ্যে থেকে অল্প বেড়িয়ে থাকা মুখের দিকে তাকিয়ে বলে "ভাই, আমার মতো মোটা মানুষের আবার নারী সংসর্গ? বলিসও ভাই...দিনের শুরুতে এভাবে মেজাজ খারাপ করাবি না। এমনিতেই সবাই দেখলে দূর থেকে পালায়, তার ওপর তোরাও যদি..."
অসীমের মেজাজ গেল বিগড়ে, লেপ খুলে উঠে বসে পড়ল বিছানায়, "বেশি সেন্টু দিলে জগের সব জল গায়ে দিয়ে দেবো। ভাই, আমি কিছু বলিনি, এই শ্যামলটাই কিছু ফিসফিস করে উস্কানি দিচ্ছিল। প্লিজ, পরের দিন আলোটা যদি একটু বন্ধ...মানে বুঝতেই পারছিস, তোর মতো আমরা এতো তো প্রাণবন্ত নই, তুই খালি..."
বিকাশ মাথা নেড়ে গম্ভীর ভাবে বলল, "আচ্ছা ঠিক আছে, কিন্তু উল্টো পাল্টা কমেন্ট বন্ধ"
"ওকে স্যার", শ্যামল লেপ মুড়ি দিল আবার। অসীম তখনও বসে ভাবছে কি করবে। ঘুম প্রায় চটকে গেছে, এরপর আরও চেষ্টা করলে বেকার বেলা হবে। "সকাল ৮টা তো বেজেই গেল... যাই আমিও...উঠেই পড়ি"
"ভাইসকল! আমি গেলাম, ইস তোদের সাথে কথা বলতে বলতে দেরী হয়ে গেল, আজ মনে হয় সোয়া আটটার বাসটা..." বিকাশ কোনও রকমে বুটের ফিতে বেঁধে ছুটে বেড়িয়ে গেল দরজা দিয়ে। শ্যামল ভাবছিল বলবে " ভাই দরজাটা ভেজিয়ে দিস..."। কিন্তু আর বলল না এই ভেবে, "যাক, অসীম তো উঠেই পড়েছে , দিয়ে দেবে" আর যাহাই ভাবা, অতএব লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে মিহি গলায় বলল , "দরজাটা তুইই ভেজিয়ে দিস অসীম।"
সামনের গলিটা মোটামুটি দ্রুত পায়ে হেঁটে শুরু করল, বার বার ঘড়ি দেখছে, এখনও বাজার পেরিয়ে অনেকটা রাস্তা। ঘড়ির কাটায় আটটা পাঁচ বাজে। সামনের ঘনবসতি পূর্ণ বাজারটা তখন প্রায় যুদ্ধ ক্ষেত্রের মতো লাগছে। দুটো অটো তার মাঝে একে অপরের সাথে বাগ বিতণ্ডায় ব্যস্ত। তারই মাঝে একগাদা বাজার সমেত কোনও দাদু রিক্সার ওপর থেকে ছাড়ছেন হুঙ্কার। সকালের স্কুলের বাচ্চা, বাজার ওয়ালার দরদাম, খরিদ্দারের ঝগড়া আরও কত কিছু। বিকাশ মোটামুটি কিছু না ভেবে লাগাল রুদ্ধশ্বাস দৌড়; দু'তিন জনকে টপকে, ওই পাড়ার মেজদা কে ট্যাকেল করে, তীরবেগে ধাবমান অটোকে পাশ কাটিয়ে যখন এসে পৌছালো মোড়ে কাছে, তখন দেখছে লাল মিনি বাসটা স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে।
"আজ মনে হয় আর পাব না", ল্যাপটপ ব্যাগটা কাঁধে চেপে এবার একেবারে সোজা দৌড় পাশের ফুটপাথ ধরে, বাসের দিকে। "কাকা, আসতে...থেমে" পিছন থেকে সেই ডাক পৌছালো না; সেই কনডাক্টর কাকা খৈনি মুখে, টেনে দিল বেল, আর বাসের চাকা গড়াতে লাগল।
বিকাশ তখনও ছুটছে, শ্বাস ফুলে আসছে। ব্যাগ কাঁধে দৌড় কখনই সহজ নয়। যখন স্ট্যান্ডের কাছে এসে পৌছালো বাস তখন দূর দিয়ে চলে যাচ্ছে আপন গন্তব্যে। হার মেনে নিল সে, মাথা নিচু করে কোমর ধরে নিজের ওপর আক্ষেপ করতে লাগল। ঘামে নতুন কাচা জামাটা ভিজে গেছে, শীতের সকালেও দরদর করে ঘেমে চলেছে প্রতি নিঃশ্বাসে। মনে মনে ভাবল, "আজ আবার মিস হল...আর দেখা হবে না।"
বাসের সম্পর্ক এরকমই হয়, হয়তো কেউ কারও নাম জানেনা, তবু কেমন যেন একটা ভালো লাগা, একটা বন্ধুত্ব নিজের মতন করে সকলেই ভেবে নেয়। সামান্য মুচকি হাসি, অভিবাদন, বা শুধুই কাউকে দেখার জন্য একটা অপেক্ষা। হয়তো সাহস করে উঠতে পারেনি কেউই কথা বলার জন্য, কিন্তু মনে মনে রোজের দেখা হওয়াটা কেমন যেন অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে।
বিকাশও একজনকে চিনত। কোনদিনও কথা বলা হয়ে ওঠেনি। লেডিসের প্রথম দিকের সিটে বসত। আগের কোনও স্টপেজ উঠত বোধহয়। কিন্তু একবার সকালে তাকে দেখলেই এক অজানা ভালো লাগায় তার মন ভরে যেত। হয়তো সারাটা দিন অপেক্ষায় পরদিন সকালে ৪৫ মিনিটের "এই সঙ্গে চলার" অনুভূতির জন্য। কোনও আশা নেই, কোনও চাহিদা নেই, তবু কেমন যেন একটা প্রেম, যেখানে শুধু রোজ দেখা হওয়াটাই অনেক তার জন্য।
"এক্সকিউস মি, বাসটা কি চলে গেল?"
বিকাশ পিছনে না ফিরেই বলল, "হ্যাঁ, এই..."
জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে পিছনে তাকিয়ে একটু শ্বাস চেপে বিস্ময়ের সাথে বলল, "না মানে, হ্যাঁ! আমি জাস্ট মিস করলাম। ডাকলাম, কিন্তু দাঁড়ালো না।"
বাসের ভিড়, টিকিট কাটার ব্যস্ততা, বাসের হ্যান্ডেলে ধাক্কা এসবের মাঝে, বিকাশ শুধু লক্ষ্য করেছে, সেই নাম না জানা সহযাত্রীর বাসের হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে যাওয়া চুল, ঈর্ষা করেছে প্রতিটি ফোন কল'কে তাকে ব্যস্ত রাখার জন্য, লক্ষ্য করেছে তার মুখ নামিয়ে অমলিন হাসি, কিম্বা নতুন কানের দুল যখন তা গাল বেয়ে নেমে এসেছে ঘন চুলের মাঝখানে, অথবা নেহাত আনমনা চোখ যখন তাকিয়ে থেকেছে বাইরের দিকে।
কিন্তু আজ প্রথম দেখল একেবারে সামনে থেকে, সশরীরে, এতটা কাছে।
মেয়েটি একটু নিরাশ হয়ে বলল, "ও, তাহলে ট্যাক্সি..."
সেই "চেনা" মুখের দিকে তাকিয়ে প্রায় যেচেই বলে ফেলল, "চিন্তা নেই, পরের বাস আর দশ মিনিটে চলে আসবে। "
হয়তো রিনাও জানতো এই নাম না জানা ছেলেটার কথা, প্রায় তিনদিন দেখেছে বাসের পেছনে ছুটেও ধরতে পারেনি। কন্ডাকটরের কাছে তার আওয়াজ না পৌঁছালেও, রিনা প্রতিদিন লক্ষ্য করেছে ওই ব্যাগ কাঁধে ছেলেটার দিকে, কখন মোড় থেকে ছুটে আসবে বাস ধরার জন্য। বাসের জানালা দিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখেছে ছেলেটার রোজ হেরে যাওয়ার গল্প। যেদিন বাসে উঠেছে, অপেক্ষা করেছে কোনও কথা বলার জন্য, কোনও একটা অজুহাতের জন্য যাতে সেই মানুষটা একবার তার সাথে কথা বলে। "নিতান্ত ভীতুর ডিম, তাই এতদিনেও কথা বলার সাহস যোগাতে পারেনি"।
রিনা তাই আজকের জন্য, আগের বাসে এসে নেমে পড়েছিল সেই বাস স্টপে, জানার জন্য তাকে। মনে মনে আশা করেছিল, "সত্যি যেন ও আজ বাসটা মিস করে"। হলও ঠিক তাই।
আসলে কখনও কখনও, একটু পা মিলিয়ে চলার নামই তো জীবন! কেউ পিছিয়ে গেলে, তার জন্যও একটু থেমে যাওয়াই তো ভালোবাসা।
একটু থেমে বিকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, "আমি রিনা, আপনি তো প্রায়ই দেখি বাসটায় যান। আপনার অফিসও কি সল্টলেকের দিকে?" সেই নাম না জানা ছেলেটাকে জুগিয়ে দিল নতুন কথা শুরু করার সূত্র।
আচ্ছা তোমার কাছে দলছুট হবার মানেটা কিরকম? অথবা কোন কোন ঘটনা বা মুহূর্ত তোমাকে নস্টালজিক করে তোলে? লিখে ফেলো একটা পাতায় যেকোনো ভাষায় সাবলীল ভাবে। অথবা মনের মধ্যে কোনও প্রশ্ন জমে উঠেছে যা জিজ্ঞেস করতে চাও আমাকে। কোনও স্বীকারোক্তি, অথবা কোনও ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে জানতে চাও স্বাধীন মতামত। নাম ও বিবরণ সহ যোগাযোগ করো আমাদের E-দপ্তরেinfo.amarbanglavasa@gmail.com । [নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হলে স্পষ্ট ভাবে তা উল্লেখ করো চিঠিতে] বাছাই করা প্রশ্ন ও উত্তরগুলি প্রকাশিত হবে আমাদের পত্রিকায়।
ধন্যবাদান্তে,
সম্পাদক-নবপত্রিকা
সম্পাদক-নবপত্রিকা
অসাধারণ 😆😃
ReplyDeleteআপনার ব্লগের লিঙ্কটি চোখে পড়লো ইন্ডিব্লগার ফোরামে। যদিও মূলতঃ আমি ইংরাজিতে লেখালেখি করি তবুও তার পাশে পাশে একটি বাংলা ব্লগও আছে। বাংলা ব্লগের সংখ্যা এতই কম যে বলার নয়। তাই উৎসাহিত হয়ে দেখতে এলাম :-)
ReplyDeleteভাল লাগল প্রথম যেটি পড়লাম, এই গল্পটা...শেষ থেকে আবার শুরু করা যায় এবং পাঠকের মনে রেশ থেকে যায়।
আমার বাংলা ব্লগের লিঙ্ক দিলাম, সময় পেলে ঘুরে যাবেন আমার ব্লগ-বাড়িতে... :-)
https://nijermoneblogblog.wordpress.com/
ধন্যবাদ, আপনার মতামতের জন্য। আসলে আমি আগে ইংরাজিতেই মূলত লিখতাম। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে, নতুন কিছু প্রেরণা ও ভালোলাগা থেকে, বাংলায় লেখা শুরু করেছি। অত্যন্ত ভালো লাগল, আরেকজন বাংলা ব্লগার এবং মতামত পেয়ে। আপনার ওয়েব সাইটটি আমি আজ দেখলাম, এবং আমি অবশ্যই আমার মতামত জানাব।
Deleteএই ই-ম্যাগাজিনে, সম্পাদকীয় বিভাগে আরও অনেকগুলো গল্প আছে, আশা করি আপনার ভালো লাগবে। আগামী সপ্তাহে আরেকটি নতুন গল্প আসতে চলেছে।
Khb valo lglo pore :)
ReplyDelete