ঘড়িতে তখন কয়'টা বাজে সেটা দেখার সময় নেই। হয়ত মানসিকতাও নেই, সেই খোঁজটুকু নেওয়ার। সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত এই তল্লাটে অনেকটা একই রকম। প্রতীক্ষার দৈর্ঘ্য এতটাই বেশি, যে নিজের ছায়াকেও ছোট মনে হতে থাকে। আর কমতে কমতে একদিন কখন যেন মানুষটা নিঃস্ব নামহীন একটা নম্বর হয়ে যায়। জীবন, পরিবার, সংসার, রাগ, দুঃখ, ঘৃণা, পশুত্ব, ভালোবাসা, খিদে সব যেন জড় পদার্থের মতো হয়ে যায় একটা মানুষের। কপালের ঘাম রক্ত হয়ে ঝরেছে মাটিতে, কিন্তু পা ভেজেনি। ব্যস্ত শহর দৌড়ে চলেছে প্রতিনিয়ত, কিন্তু কারও খেয়াল হয়না পাঁচিলের ওপারে কি ঘটে চলেছে। সময় সেখানে স্থির, মৃতপ্রায়।
কখন যেন কয়েকবার ঘণ্টা বেজে গেল, কিন্তু গুনতে যেন সবাই ভুলে গেছে। ছোট্ট ছেলেটা আধো ঘুমে বসে আছে বেঞ্চে, মায়ের হাত ধরে। জায়গাটা বেশ অন্ধকার, শুধু মাঝে মাঝে কিছু পুরনো ঝুল-পড়া বাল্বের আলো চিনিয়ে দিচ্ছে পথ। একটা সরু পথ, যেটা অফিস ঘরের থেকে বেঁকে চলে গেছে অনেক গুলো সার দেওয়া কুঠুরির পাশ দিয়ে।
"সরকার দা, আরে ফাইলটা কোথায় রাখলেন? ধুর মশাই, আপনাকে দিয়ে আর কাজ হবে না। প্রতিবার বলেছি , এই সব সেনসিটিভ ফাইল আমার ডেস্কে রাখবেন। কাজ না পোষালে রিটায়ার করে যান। বয়স তো কম হলনা। ", বড়বাবু একটু বিরক্ত ভাবে উষ্মা প্রকাশ করলেন। বছর চল্লিশের ভদ্রলোক, বেশ সুঠাম গড়ন, কাঁচাপাকা চুল, শ্যামলা ব্রনময় মুখে চশমা হেলে এসেছে নাকের ডগায়। টেবিল ল্যাম্পের আলোয় পাতার পর পাতা উল্টে চলেছেন, আর মাঝে মাঝে দূরে বসে থাকা মহিলার ঠোঁট থেকে গলার কাছে বেয়ে নেমে আসা চিকচিকে ঘাম নিখুঁত দৃষ্টিতে আড়চোখে উপভোগ করছেন। "কি, কেন, কোথা থেকে "- এসব ভাবার আদৌ কোনও উৎসাহ নেই, কিন্তু নজরের সামনে থেকে এই বন্য আনন্দকে ছাড়তেও পারছেন না। মুখে এই সমাজ যতই বড়াই করুক, ভেতরের আদিমতাকে কয়জন চেপে রেখেছে?
ঊষা দূরে বসে সব বুঝতে পারছিল, কিন্তু তার কিছু করার ইচ্ছে ছিল না। সময় ঘটনা আর কিছু ভুল একটা পরিবারকে তছনছ করে দিয়ে গেছে। এখন, শুধু মৃতদেহ পড়ে আছে হিমঘরে। প্রতিদিনের আলো আর অন্ধকার একে একে তাদের কবরে আক্ষেপের চাদর চাপিয়ে চলেছে। ঘামে ভিজে গেছে শরীর, গলায় অসম্ভব তৃষ্ণা। সন্তু প্রথমে চুপ করে বসতে চাইছিল না, বার বার মুখে নানা শব্দ; আর থেকে থেকে তার সেই রোজকার আবদার করে চলেছে, "মা, মা, আমি আজ ...।" বারবার কথাগুলো কানে বাজছিল ঊষার, তাই ধমক দিয়ে চুপ করে বসিয়ে দিল। আর তারপর সন্তু কোনও কথা বলেনি। চুপ করে পা দোলাতে দোলাতে কখন মায়ের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছে। এই নিয়ে প্রায় দুঘণ্টা বসে আছে একই বেঞ্চে। শুধু একবার দেখা করার জন্য।
"ফাইল টেবিল থেকে টেবিলে সরতে সময় লাগে। সরকারি কাজ। আপনার তাড়া থাকতে পারে, আমাদেরও তো কাজ আছে নাকি? উনি তো আর মহাপুরুষ নয়। প্রায় ২০টা তাজা প্রাণ... " শুধু একটা গভীর উষ্ণ নিঃশ্বাস পড়ল, কিন্ত বাক্য শেষ হল না। হয়তো তিনি চানও না সেই ঘটনার পুনরুত্থাপন করতে। "পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে আর লাভ নেই। আপনার আর্জি যেমন আছে, আমাদেরও একটা আছে। আমাদেরটা হল, ওই যে দূরে বেঞ্চ দেখছেন? ওইখানে বসুন। অপেক্ষা করলে, আমরাও আপনার আর্জি শুনব", ঠিক এই ভাষাতেই উত্তরটা এসেছিল যখন ঊষা অনুনয়ের সুরে বলেছিল, "একবার দেখুন না স্যার, আপনি তো সব জানেন। একবার দেখা করতে দিলে ভালো হত। বাচ্চাটা কয়েকদিন ধরে খুব..."
ধমকের সুরে উত্তর এসেছিল, "এখন থেকে অভ্যেস করান, পড়ে নাহলে বিপদ হবে। আর তো কটা দিন। একবার অর্ডার এলে..."
"আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন? আমি তো শুধু..." ঊষা অনুরোধের সুরে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বড়বাবুর কড়া জবাব, "আপনার স্বামী একটা ক্রিমিনাল। একটা ব্রুট। ফাঁসির আসামীর জন্য আমাদের এতটুকুও দয়া নেই। যে কাজ সে করেছে তার উচিত মূল্য তাকে পেতে হবে। আপনার ভালর জন্যই বলছি, এখন থেকে মনকে শক্ত করুন। আর ..."
একটু থেমে একটু ভারি গলায় ছটফটে সন্তুর দিকে তাকিয়ে বললেন , "ওকে ভালো স্কুলে দিন। পিতৃ পরিচয়...থাক! ওকে একদিন না একদিন তো এটা বুঝতেই হবে..."
কিন্তু দুঘণ্টা কেটে গেছে, করুণার এতটুকু জল এসে পড়েনি ঊষার শুকনো ঠোঁটে।
"ম্যাডাম, চলুন এবার...", একজন বয়স্ক অফিসার পাশ থেকে বললেন। দূর থেকে একটা কণ্ঠ ভেসে এল, "সরকার মশাই, টাইমটা দেখে সব চেক করে নেবেন।" তিনি মুখ ফিরিয়ে বললেন , "চলুন এবার..."
ঊষার তখন আসতে আসতে ঘোর কেটেছে। সন্তু অল্প নড়াচড়াতেই জেগে উঠল। তারপর মায়ের হাত ধরে দেখা করতে গেলে সেই কমন প্লেসে যেখানে আসামীদের দেখা করা যায়। জালের বেড়া, লোহার কব্জায় কব্জায় দূরত্বের হুঙ্কার। একটু পরে, অনিমেষ আসতে আসতে হেঁটে এল।
সন্তু এভাবেই বাবাকে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে বিগত কয়েক বছরে। ঊষার চোখ বেয়ে জল নেমে আসছিল। ঠোঁট কেঁপে যাচ্ছিল। সন্তুর কলার ধরে আঁকড়ে ধরছিল নিজের কাছে। যেন, তার বাবার কুকর্মের ছায়া যেন তাকে স্পর্শ না করতে পারে। তার আজও বিশ্বাস হয়না, তার স্বামী...
সন্তু বাবাকে দেখেই উৎফুল্ল হয়ে জালের অনেকটা কাছে এগিয়ে এল দেখার জন্য। মুখ তুলে জালের ফাঁক দিয়ে আঙ্গুল গলানোর চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু এই "ব্যবধান" ছোট্ট আঙ্গুলের থেকে অনেক বড়। শিশুর আঙ্গুল কখনও কি কাঁটাতার পেরোতে পারে?
অনিমেষ, হয়ত সমাজের কাছে নিকৃষ্ট কীটের মত অধমে পরিণত হয়েছে, কিন্তু তার পিতৃসত্তা এখনও আকুল সন্তুর জন্য। ঊষার সাথে চোখে চোখ রাখার সাহস ওর নেই। চোখ নামিয়ে যখন জল রোখার চেষ্টা করছিল,
নিঃশব্দের কুয়াশা ভেদ করে, সন্তু, একগাল হেসে শুধু একটাই ছোট্ট প্রশ্ন করল, "কেমন আছো তুমি?"
(ক্রমশ প্রকাশ্য, পড়তে থাকুন। পরবর্তী অংশ পরের প্রকাশনায়।)
সম্পাদক-নবপত্রিকা
No comments:
Post a Comment