"তোমায় হৃদমাঝারে রাখবো, ছেড়ে দিব না...", অনেকটা দেশোয়ালি সুরে গেয়ে চলেছে মানুষটা। চোখ বন্ধ করে আপন মনে বাজিয়ে চলেছে হাতে ধরা মলিন একতারা, আর ঠোঁটের প্রশস্ত উচ্চারণে ধরতে চাইছে প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি সুর। কোঁকড়ানো তেল চিকচিকে চুল কাঁধের ওপর নেমে এসেছে, শ্যামলা কঠিন মুখ, যাতে জরা-ব্যাধি আর রোজকার দিনমজুরির ছাপ অনেকটাই ফুটে উঠেছে কালের নিয়মে। হয়তো লোকটার এটা পেশাই নয়, নেহাত সখে মিশে যেতে চেয়েছে মানুষের মাঝে, মাধুকরীর অজুহাতে। চৌকো কাপড়ের টুকরো লাগানো ময়লা জামার সারাটা অংশে। মাথা দুলিয়ে গেয়ে চলেছে বগির এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে; কেউ শুনছে, কেউ ভিক্ষা দিচ্ছে। কখনও বা তার কথা মিশে যাচ্ছে কারও অন্তরের গভীরে।
কখনও কারও নিরুত্তর দৃষ্টি, কখনও কারও নিশ্চুপ ভাবনা, কখনও নেহাত অগ্রাহ্য- তবু বারে বারে ফিরে এসেছে সেই লাইন "ছেড়ে দিলে সোনার গৌড়, আর তো পাব না"। রমার খেয়াল ছিল না এসবের প্রতি। অনেকটা আনমনা ভাবেই তাকিয়েছিল জানালার বাইরে, যখন মাটিয়ালি গন্ধ ছুঁয়ে যাচ্ছিল ওর গাল; ট্রেন ছুটে চলেছে মাঠ- নদী- শহর পেরিয়ে। অনেকটা বেলা হয়ে গেলেও, সকালের কুয়াশা তখনও জড়িয়ে রেখেছে মাঠের ওই দূরের প্রান্ত, শিমুলতলা, ঢেউ খেলানো অসমান পুকুরের পাড়,
কলাগাছের বন, আল পেরিয়ে হেঁটে যাওয়া নীল সোয়েটার পড়া স্কুলমুখো কচিকাঁচার দল। অনেকটা উৎসাহের সাথে রমা তার গাল রাখল জানালার রডের ওপর, মেঠো হাওয়ার সবটুকু শরীরে নেবার জন্য, যখন কোনও নাম না জানা গায়কের মাধুকরী গুনগুন করে উঠছিল তার ঠোঁটে।
আজ অনেক দিন বাদে, মেয়ে ঘরে ফিরছে। কিন্তু হায়, জন্মভিটেতে আর কেউ থাকে না যে তাকে অভ্যর্থনা জানাবে। অন্ডাল ষ্টেশন থেকে নেমে প্রায় মাইলখানেক দূরে একটা গ্রাম। নাম নেই। লোককথায় মন্দির বা পুজোর জায়গার নামেই এখানে অধিকাংশ এলাকা চেনা হয়। "আদি বটতলা"। রমা যখন অনেক ছোট ছিল, জ্ঞান তখন অনেকটা হয়েছে; ওর বাবা কর্মসূত্রে চলে আসেন শহরে সপরিবারে। তারপর বছরে এক-দু'বার আসার চল ছিল। কিন্তু ঠাম্মি চলে যাবার পর, সত্যি বলতে "সময়" আর কারও হয়ে ওঠেনি। ভিটেমাটি তাই রয়ে গেছে, কিছু আত্মীয় স্বজন থাকে আসে পাশে। এখানের আত্মীয়তা রক্তের সম্পর্কের থেকে আলাদা।
"আই নিড এ ব্রেক", মিটিং রুম থেকে ঠিক এই কথাটা বলেই বেড়িয়ে এসেছিল গত বুধবার। আর ফিরে তাকায়নি। ক্যাফেটেরিয়াতে অনেক ক্ষণ চুপ করে বসেছিল, রমা।
"তোর তো লম্বা উইকেন্ড। চল তাহলে, ভাইজাগ, কিম্বা দিঘা"
"এই শোন! ওই কোনা এক্সপ্রেসওয়ের ধারে নতুন কিছু বার খুলেছে, রিসোর্টও আছে। কয়েকদিন কাটিয়ে এলে কেমন হয়? আমি ট্যারিফ জিজ্ঞেস করে নেব। সাধ্যের মধ্যে বেশ জমিয়ে কাটানো হবে।"
"ধুস, তোর কথা রাখতো! আমি বলছি; উইকেন্ডে সিনেমা, পার্টি, হই হুল্লোড় এটাই বেস্ট। আমার কাছে পাস আছে। যাবি তো বল। "
রমার তথাকথিত বন্ধু বান্ধবীরা যখন আপন মনে তার এই "ব্রেক" সিদ্ধান্তের কাটাছেঁড়া করছে, ভাবনাচিন্তা করছে কিভাবে সেটাকে সদব্যবহার করা যায়, রমা তখনও নিজের খেয়ালে মশগুল। মাটি থেকে সিলিং অবধি উঠে যাওয়া কাঁচের দেওয়াল দিয়ে বাইরের রাস্তা দেখছে আপন মনে, যখন ট্র্যাফিকের আলো, রাস্তা,বাস ট্রামের ব্যস্ততা, ফুটপাথের ফেরিওয়ালা, বাস স্টপে অপেক্ষায় থাকা কোনও প্রেমিক, কফি হাউসের আড্ডা, কলেজ ষ্ট্রীটে বইয়ের দরদাম, শহরের অফিস ফেরত মানুষগুলো
মেঠো রঙে ধুয়ে যাচ্ছিল। মাটির আঁচড় এসে লাগছিল ওর গালে, যখন নিজের ছায়া দেখতে পেল সেই কাঁচের দেওয়ালে। চোখ বুজে গালে ছুঁয়ে দেখল সেই মাটির আস্বাদ আর আঘ্রাণ। বুঝেছিল, তার গন্তব্য অন্য কোনও দেশ, অন্য কোনও খানে। শহরের জঙ্গল থেকে বেড়িয়ে আসতে, তাই মনে পড়েছিল শ্যামল সবুজ এই অজ পাড়াগাঁয়ের কথা।
একের পর এক ষ্টেশন পার করে ট্রেন তখন "রেলগাড়ি" হয়ে ছুটছে "কু ঝিক ঝিক" ধোঁয়া উড়িয়ে। নাহ বাস্তবে নয়, তবে রমার মনে পড়ে যাচ্ছিল তার ছোটবেলার সেই অভ্যাসের কথা, যখন ঘরের এক কোণে মুখ গোমড়া করে বসে থাকত সে। ছোট্ট লাল শাড়ি পরে কখন থেকে সে তৈরি; বাবার সাথে দেখতে যাবে রেল গাড়ি- ওই মাঠের পাড়ে। কিন্তু "বাবা যেন খুকুর খেয়ালই রাখে না, সব সময় আসতে দেরী"। রমার মন তাই ফিরে যাচ্ছিল তার ছোটবেলার অলি গলিতে।
ট্রেন যখন এসে থামল, তখন প্রায় দুপুর। রিক্সা করে বেশ খানিকটা যেতে হয় লাল কাঁকরের রাস্তা ধরে, তারপর বাকিটা পথ পায়ে হেঁটে। শুধুই মাটির আল, বাঁশবন, সরু হয়ে যাওয়া মেঠো খালের পাড়, অথবা বাঁশের সাঁকো। টাইম মেশিনের মতো প্রত্যেকটা মুহূর্ত তাকে ফিরিয়ে দিচ্ছিল তার মেয়েবেলায়, যখন স্কুল ফেরত সে হেঁটে যেত ঠিক এই পথ বেয়ে। এখন কিছু পাকা বাড়ি হয়েছে, অনেক জায়গার রূপরেখাই পরিবর্তিত হয়ে গেছে, তবু স্মৃতি তার পিছু ছাড়েনই। যেটুকু অমিল ছিল তা তার মনের ভাবনা নিজের মতো করে মিলিয়ে নিচ্ছিল।
"তুমি কি শহর থেকে আসছ?"
কথাটা শুনেই রমা আশেপাশে তাকালও। ঠাওর করতে চাইল, কে তার মতো এক অজানা মেয়ের সাথে কথা বলতে চাইছে, এই ভর দুপুরবেলা। খানিকটা উঁচু ঢিবির মতো জায়গায় উঠে ফিরে তাকালও। দূরে গাছপালার পাশ দিয়ে চলে যাওয়া মেঠো আলের ওপর একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে। শাড়ি পড়ে মিষ্টি দেখতে গড়ন। "তুমি শহর থেকে আসছ?", আবার জিজ্ঞেস করল কৌতূহল থেকে। তার কথা বেশ দূর থেকেও শোনা যাচ্ছিল। রমাকে ফিরে তাকাতে দেখে, ছোট্ট পায়ে দৌড়ে চলে এলো তার কাছে, খানিকটা কাছে এসে ভয়ে থেমে গেল।
"হ্যাঁ গো, আমি সেখান থেকে আসছি। কোলকাতা। নাম শুনেছ?", রমা মুখ নামিয়ে এক গাল হেসে বলল।
"হ্যাঁ, শুনেছি। বাবা বলে কোলকাতার কথা, শুনেছি, ওখানে অনেক বড় বড় গাড়ি চলে। " কোমর দুলিয়ে হেসে হেসে বলল মেয়েটা।
"তুমি যাবে আমার সাথে সেখানে?"
আঙ্গুল খানি ঠোঁটের ওপর রেখে, ভাবল কিছুক্ষণ তারপর বেশ খিলখিলিয়ে হেসে উত্তর "তুমি মজা করছ। নানা, আমার পড়া আছে। মা -বাবা বকবে। ঠাম্মির গল্প ছাড়া আমার ঘুম হয়না। তুমি আমায় গল্প শোনাবে?"
রমা বেশ আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছিল তার কথা শুনে। অনেকটা "ভালো" অনুভব করছিলো তার সাথে কথা বলে। মনে পড়ে যাচ্ছিল তার নিজের কথা। একটু এগিয়ে এসে তার হাত ধরে কাছে টেনে নিল, মুখ মুছিয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, "তোমার বাড়ি কোথায়? কি করছ এই দুপুরবেলা এই মাঠের মধ্যে?"
বেশ গম্ভীর হয়ে গেল ছোট্ট মেয়েটার মুখ, "নাহ! মানে", আমতা আমতা করে বলল, "ওদের বাড়ি খেলতে গেছিলাম। আজ তো স্কুল নেই। তাই ভাবলাম... তুমি আমায় বকবে? জানো, আমার ঠাম্মি আমায় কত্ত ভালবাসে। তুমি আমাকে বকেছ শুনলে..."
রমা হাসি ধরে রাখতে না পেরে বলল, "চল তাহলে, আমার সাথে... তোমার বাড়ি কোথায়? আমি যাব আদি বটতলা। তুমি জানো কিভাবে যেতে হয় সেখানে?"
"হ্যাঁ, ওই তো! দূরের ওই নারকোল গাছটা থেকে যে রাস্তাটা মাঠের ধার দিয়ে নেমে গেছে, ওটা দিয়ে এগোলেই দেখতে পাবে।"
"বাহ! তুমি তো বেশ ভালো মেয়ে..." রমা গাল টিপে আদর করল তাকে। তারপর হাত ধরে এগোতে থাকল মাটির রাস্তা ধরে। গ্রামের দুপুর বেশ নিঝুম হয়। রাস্তায় তাই লোকজনও নেই। কাউকেই তো দেখা গেল না, এই ছোট্ট মেয়েটা ছাড়া।
"তোমার কি কি করতে ভালো লাগে?" রমা কৌতূহল বশত জিজ্ঞেস করল।
"পুরনো নৌকাটার ওপর পা ঝুলিয়ে বসতে ভালো লাগে, ছেলের দলের সাথে ঘুড়ি ওড়াতে ভালো লাগে। পুতুল খেলা, রেল গাড়ি, ঠাম্মির গল্প, চুল বেঁধে দেবার সময় মায়ের আদর, বাবার সাথে মেলার মাঠে নতুন খেলনা আরও কত কিছু। তুমিও এসব করো?"
রমা ফিরে তাকালও ছোট্ট মেয়েটার মুখে, একটু করুণভাবে। হয়তো বড় হবার সাথে সাথে মেয়েবেলা যেন হারিয়ে গেছে তার জীবন থেকে। সময়ের সাথে তার ভালো লাগাগুলো পরিবর্তিত হয়ে গেছে। কথাগুলো শুনে রমা ফিরে যাচ্ছিল তার মাটির বাড়ির দাওয়ায় যেখানে সারাটা দুপুর কাটতো বন্ধুদের সাথে "কিত কিত খেলে"।
খানিকক্ষণ চুপ থেকে ফিরে তাকালো ছোট্ট মেয়েটার মুখের দিকে, "তুমি কে? তোমার নাম কি?"
"আমি রমা, আমি তোমার হারিয়ে যাওয়া মেয়েবেলা"
খানিক বাদেই একটা জোরে ঝাঁকুনি অনুভব করল রমা। ট্রেনের গমগমে আওয়াজে যখন চোখ খুলল, তখনও রমা বসে আছে সেই জানালার ধারে। ট্রেন ঢুকছে ষ্টেশনে।
গানওয়ালার সেই গানে, জানালা দিয়ে বয়ে আসা মেঠো গন্ধে, দূরের কুয়াশায় ঢেকে থাকা সবুজে মিশে ছিল অদ্ভুত কোনও নস্টালজিয়া, যা রমাকে ফিরে দিয়েছিল তার পুরনো দিনগুলোতে।
ধন্যবাদান্তে,
সম্পাদক-নবপত্রিকা
No comments:
Post a Comment