Code

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

Second Header

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

Monday, June 13, 2016

আজ যদি শেষ... - দ্বিতীয় পর্ব


কথা বাকি ছিল, তাই আবার ফিরতে হল আবার গল্পের মাঝে। কারণ গল্পের পুঁথিমালা দিয়েই সাজানো আমাদের জীবন, আর সেই জীবন কখনও থেমে থাকতে পারে না।বৃষ্টির পর পাতার ওপর যেমন ভাবে বিন্দুরা ভিড় করে আসে সূর্যস্নানের অপেক্ষায়, ঠিক তেমন করেই আমাদের প্রত্যেক অনুভূতি চুইয়ে পরে রৌদ্র-ছায়ার খেলার মাঝে। আমরা হয়তও আমাদের নিকস অন্ধকার ছায়াগুলো নিয়ে বড় কাতর হয়ে পড়ি; কিন্তু জানালার ওই পাড়ে যে শিমুল গাছ? সেই গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে চঞ্চল মেয়ের মতো উকি দেওয়া যে রোদ্দুর আছে, তার কথা কতবার ভাবি?"আজ শেষ দিন" এই কথাটা ভাবতে মন যতটা ভারি হয়ে যায়, হয়তও সেই ভাবেই বিষণ্ণ ঠোঁটে এসে যায় প্রশান্তির হাসি- এতটা পথ পেরনোর অমলিন আনন্দে। তাই নয় কি?

তাই মাধবীর গল্প বলার আগে, আরেকবার ফিরে যাবো সুব্রত আর বরুণের কাছে। ভাবতে অবাক লাগছে? প্রথম পর্ব জুড়ে যখন ছড়িয়ে ছিল, শেষ হয়ে যাবার হাহাকার, তখন আমরা দেখেছি এই দুটো ভিন্ন দুনিয়ার মানুষকে একই অভিমানে দগ্ধ হয়ে যেতে। বারে বারে ফিরে এসেছে, সেই আক্ষেপ, "আরও যদি একটু সময় পাওয়া যেত...... এই মুহূর্তের আর ভালোলাগার নির্যাস যদি আর একটু মেখে নেওয়া যেত।" কিন্তু শেষ দিন মানে কি সত্যিই শুধু আক্ষেপ? গল্পের শেষ মানেই কি, পথের অন্ত?জীবনের রঙ্গমঞ্চ থেকে একটা চরিত্রের অবলুপ্ত হয়ে যাওয়া মানেই কি তার সাথে জড়িয়ে থাকা অজস্র স্মৃতিলেখার মুছে যাওয়া? নাহ! তা তো কখনও হতে পারে না। হয়তও আমরা নিজেদের নিয়ে ভাবি খুব কম, কিন্তু শেষের দিনে একবার নিশ্চয় আমাদের মন চাইবে ফিরে দেখতে সেই পাতাঝরা রাস্তাগুলোর দিকে, যেখানে আনাচে কানাচে দেখা হয়ে গেছে নামহীন বহু মানুষের সাথে, অগুনতি ঘটনা মৌচাকের মতো ভিড় করে গেছে, যেখানে নানা মুহূর্ত রয়ে গেছে মাইলস্টোনের মতো। কি তাই না? শহর ছেড়ে চলে যাবার আগে রিমার মনে পড়ে যাবে সাগ্নিকের কথা যে প্রতিদিন অপেক্ষা করত বাস স্টপে- হাতে একটু সময় নিয়ে, একবার তাকে দেখার জন্য। অবিনাশের মনে পড়বে সেই ট্র্যাফিক সিগনালে গোলাপ হাতে মেয়েটার কথা; যে জানালার কাঁচে এসে দিত টোকা আর একগাল হেসে বলত, "ফুল নেবে?"; আর অবিনাশ খুঁজে নিত তার সকালের ফুল সেই মিষ্টি অম্লান হাসির মধ্যে। সঞ্চিতার লাইব্রেরীর সেই ডেস্কের কথা মনে পড়বে যেখানে অনুপম কম্পাস দিয়ে আকি বুকি কেটে যেত ক্রমাগত, তার শত মানা সত্ত্বেও। শুধু কলেজের শেষ দিনে, যখন তাকে দেখতে পায়নি তখন লাইব্রেরীতে তাকে খুঁজতে গেছিল সঞ্চিতা; নাহ! অনুপমকে দেখতে পায়নি, শুধু দেখেছিল কবে যেন সেই আঁকিবুঁকি "সঞ্চিতা" হয়ে গেছে টেবিলের গায়ে। নতুন দলে যোগ দেবার আগে রুদ্রের মনে পড়ে যাবে ৫/৫ শ্যামবাজার স্ট্রীটের ঘর, যেখানে সন্ধ্যে হলেই বসত নাটকের মহড়া, আর আসিফ'দার সাথে জমে যেত আড্ডা। নতুন ফ্ল্যাট নেবার পর, কিংশুকের মনে পড়ে যাবে নীচের ঘরের মাসিমার কথা, যার কাছে দুপুর হলেই বসত অন্নপূর্ণার হাড়ি;"বাবু, আর দুটো ভাত নিবি?" বলে কাছে ডেকে নিত নীচের ঘরে। বিয়ে হয়ে যাবার আগে, সঞ্চারীর মনে পড়বে ছোটবেলার ঘর যেখানে কেটে গেছিল তার "মেয়েবেলা"- পুরনো আয়না, হাতের লেখার খাতা, "ওর" দেওয়া প্রথম চিঠি, ডায়েরির ভাঁজে শুকিয়ে যাওয়া গোলাপের পাপড়ি, আলমারির গায়ে লাগানো লালচে টিপ আর দেওয়াল জুড়ে রং পেন্সিলের আকি বুকি।

যে কোনও গল্পের শেষ মানেই, নতুন গল্পের শুরু। পুরনো সব কিছু আছে বলেই আমাদের স্মৃতি এত সুন্দর। আর নতুন আছে বলেই আমরা আগামীর সূর্যের জন্য বসে থাকি অপেক্ষায়। তাহলে একবার ফিরে দেখা যাক সুব্রত আর বরুণের গল্প।

ঘড়িতে তখন সাড়ে চারটে বাজে, স্কুলের ঘণ্টা বেজে গেছে মিনিট পাঁচেক হল। কিন্তু সারা স্কুলে তখনও কোনও আওয়াজ নেই। কেমন যেন একটা অদ্ভুত লাগল বরুণের। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে এগিয়ে এলো দরজার দিকে। দরজার কাছে এসেই মনে হল কেমন যেন একটা গুঞ্জন ক্লাসঘরের পাশে। মনে হচ্ছে বাইরে কারা যেন দাড়িয়ে আছে তার অপেক্ষায়। "নাহ, মনের ভুল মনে হয়..." ভাবতে ভাবতে ডাস্টারটা নিয়ে মুছে ফেলল সারাটা বোর্ড; হয়তও অভিমান- "আর রেখে যাবো না কোনও দাগ এই স্মৃতি গুলোর মাঝে..."; আর আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দেখল সেই পড়ানোর টেবিল। মনে পড়ে যাচ্ছিল, তার প্রথম বার "মাস্টারমশাই" হবার মুহূর্ত, মনে পড়ছিল সেই দস্যি ছেলেটার কথা যাকে একদিন খুব শাস্তি দেবার পর পরম স্নেহে কাছে ডেকে নিয়েছিল আর দিয়েছিল "ভাল মানুষ হবার শিক্ষা"; মনে পড়ছিল মাঝের বেঞ্চে বসে থাকা চুপচাপ ছেলেটার কথা যে আনমনে বসে থাকত জানলার দিকে চেয়ে। মনে পড়ছে, রিতমের কথা, যে কোনোদিনও ক্লাসে চুপটি করে বসত না, কিন্তু অঙ্কও কোনোদিনও করেনি ভুল তার ক্লাসে। মনে পড়ছে খুব ঝড় জলের দিনেও ব্যাগ মাথায় কাকভেজা হয়ে স্কুল আসা ছানাপোনাদের কথা, যাদের নিজের হাতে মুছিয়ে দিয়েছিল সে। টিচার্স রুম থেকে নতুন জামা কাপড় এনে দিয়েছিল তাদের জন্য। মনে পড়ছে শীতের দুপুরে ফুটবল খেলতে গিয়ে পায়ে চোট পাবার কথা, যখন তার ক্লাসের ছাত্ররা হয়ে যেত বন্ধু। মনে পড়ছে হেড স্যারের রুমে দাড়িয়ে তর্কের কথা, যখন তার কাছে জবাবে জানতে চাওয়া হয়েছিল "ক্লাসের ছেলেপুলেরা অন্য স্যারের ক্লাস কেন করে না?" ডাস্টার দিয়ে মুছতে মুছতে হেসে ফেলছিল বরুণ। এই ঘর থেকে বেরনোর আগে তার হাতে রয়ে যাবে চকের দাগ;অনেকটা "দু হাত মুঠো করে আঁকড়ে" নেওয়া স্মৃতি যা রয়ে যাবে তার সাথে। একরাশ কিছু ভাল ছবি যা হয়তও চলে যাবার দুঃখকে করে দেবে ম্লান।
"হিহি", আবার কিছু শব্দ ক্লাস রুমের বাইরে। বরুণ কৌতূহল নিয়ে রুমের বাইরে চলে এল, আর যেটা দেখল সেটা হয়তও তার এই জীবনের সব চেয়ে সেরা পাওনা। গোটা স্কুলের করিডোর গিজগিজ করছে ছোট্ট ছোট্ট মুখে, কারো হাতে ফুল, কেউ এনেছে ড্রয়িং বই, কেউ এনেছে বাগানের ফল, কেউ এসেছে খালি হাতে একরাশ ভালোবাসা নিয়ে; এতগুলো ছটফটে মুখ, কিন্তু কারো মুখে একটুও "রা" নেই, শুধু অপেক্ষা করছে তার জন্য। দূরে, পিয়নশ্যামলদা দাড়িয়ে আছে। খুব করুণ মুখে বলল, "স্যার, ওরা আপনার অপেক্ষা করছিল, আপনি......"

বরুণ এগিয়ে যেতেই একটা ছোট্ট ছেলে এসে জড়িয়ে ধরল কোমর। নরম হাতে আঁকড়ে ধরে আছে তাকে, যখন বরুণ ভেসে যাচ্ছিল ভালোলাগার স্রোতে। নাহ সে কাঁদেনই, বরং সেই ছেলেটা মুখ তুলে খিলখিলিয়ে হেসে বলেছিল, "আবার আসবেন তো মাস্টারমশাই?" বরুণ ধরে রাখতে পারেনি চোখের জল, তবে আনন্দে। বলতে চাইছিল অনেক কিছু ওই ছেলেটার মাথায় হাত রেখে, তবু ঠোঁটের সামনে এসেও কথা থেমে গেছিল, মুহূর্তের মায়ায়। কিছু মুহূর্তের জন্য কথা হারিয়ে ফেলেছিল সে। বুঝতে পেরেছিল, একটা গল্পের "শেষ" মানে, অনেক কিছু পাওয়া। সারাটা গল্প জুড়ে যে "মুহূর্ত" এর অপেক্ষা, সেটা গল্পের শেষ নাহলে কি পাওয়া যায়? বরুণ হয়তও যা চেয়েছিল, পেয়েছিল তার থেকে সহস্র গুন বেশি।

সুব্রতর গল্প কিন্তু ছিল আরেকটু অন্য রকম। রিটায়ারমেন্টের ফেয়ারওয়েল দুদিন আগেই হয়ে গেছিল। আজ শুধু ছিল, প্রয়োজনীয় কিছু ফাইলের ফর্মালিটি। মানে যাকে বলে খাতায় কলমে, "শেষ হয়ে যাবারপ্রস্তুতি"। চাকরিজীবনের শেষ প্রান্তে এসে যখন সে এসে দাঁড়িয়েছিল সেই "অচেনা রাস্তার মোড়ে" যেখানে ছিল শুধু একটা পর্দা ঢাকা টেবিল, তখন সবুজ পর্দা ঘেরা তার অফিস্রুমের বাইরে ছিল "দ্বিতীয় পৃথিবী"। সত্যিই কত আশ্চর্যের। বলা যা! তার দ্বিতীয় পরিবার হয়ে গেছিল এই অফিস। সারাটা জীবন যত ভাল মন্দ মুহূর্ত কেটেছে এখানে সেই সব টুকু আজ সুব্রতর মনে পড়ছে। "ও গানওয়ালা" গানটা শেষ হয়ে যেতেই তার ঘোর কেটে গেল। এফ এমে তখন কিছু বিজ্ঞাপন চলছে, বন্ধ করে দিল সেটাকে সুব্রত। কেমন যেন একটু অস্বস্তি লাগছিল। ঠিক সেই মুহূর্তেই একটা "ইচ্ছে"জেগে উঠল তার মনে আর যেটা এই মুহূর্তে মিটিয়ে ফেলার জেদ চেপে গেল। একবার ঘুরে দেখতে ইচ্ছে করল তার সেই "তিরিশ বছরের" নস্টালজিয়া। করিডোর দিয়ে এগিয়ে ডানদিকের যে প্যাসেজ সেখানে তিন নম্বর ঘরে প্রথম এসেছিল মাঝবয়েসি এই ছেলেটা যাকে এখন সবাই "স্যার" বলে সবাই সম্বোধন করে। নতুন ইস্ত্রি করা নীল শার্ট, আর ধুতি এই ছিল তখনকার "ফর্মাল"। যতদূর মনে পড়ে, চশমা তখনও নেয়নি সে। এরপর দুবার বদলি হয়েছিল কোলকাতার আরেক অফিসে, কিন্তু চার বছর বাদে, আবার এইখানেই ফিরে আসা উঁচু পদে। তারপর থেকে এইটাই তার বৈঠকি বন্ধুমহল হয়ে গেছিল। দূরের যে নতুন অফিস বিল্ডিং টা দেখা যাচ্ছে, এটার প্রস্তাবনায় তারও যোগ ছিল। হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে এলো সিঁড়িটার দিকে, যেখানে প্রতিদিন নমাজ পড়তে জড়ো হত সামসুদ্দিন, ইকবাল, আসিফ, মিজানুর। এই চাতাল থেকে এগিয়ে গেলে সিঁড়ি। সেখানে দেওয়াল জুড়ে আছে রঙিন স্লোগান। "শ্রমজীবী মানুষের অধিকারের জন্য আমাদের লড়াই, চলছে চলবে......"। আনমনে সেই পোস্টারগুলোতে স্পর্শ করতে করতে নেমে আসছিল সিঁড়ি দিয়ে যখন সে অজান্তে ডুবে যাচ্ছিল তার সময়কার দিনে। সেই সময়ে বামপন্থী আন্দোলনে পা মিলিয়েছিল সুব্রত; মনে আছে "রমার" সাথে তার প্রথম দেখা হবার গল্প। "রমা", সুব্রতর স্ত্রী। আন্দোলনের মঞ্চে একসাথে পা মেলাতে মেলাতে, কবে যে দুজন এক সাথে সারা জীবন কাটানোর ইচ্ছে বেছে নিয়েছিল, সেটা দুজনের কেউই জানেনা। সন্তান হবার পর, রমা আর অফিসে যোগ দেয়নি, বরং একা হাতে সামলে নিয়েছিল সুব্রতর "ছোট্ট সংসার"।

"নমস্কার স্যার",বলেই একজন ভদ্রলোক পাশ দিয়ে হেসে চলে গেলেন। সুব্রত মুখ ফিরিয়ে দেখার আগেই সে যেন ভিড়ে মিশে গেল। আর অবাক হয়ে দেখল, এমন অজস্র মুখ, যারা বারে বারে এসে গেছে তার জীবনে। একটু আগে যে "স্বর সে শুনতে পাচ্ছিল, সেই অজানা রাস্তার মোড়ে", এখন সে দেখতে পাচ্ছিল সেই মুখগুলোকে। সেই মানুষগুলো যারা বারে বারে জানিয়েছে তাকে ধন্যবাদ, যারা করজোড়ে ঋণী হয়ে গেছে তার উপকারে; যারা আপদে বিপদে পাশে পেয়েছে তাদের "সুব্রত" দাদাকে। অফিস কেটে কফি হাউসে গিয়ে রমার সাথে দেখা, বিকেল চারটের সময় গরম "ফিস কাটলেট", অঝোর বৃষ্টির দিনে একসাথে অফিস্রুমে বসে মুড়ি চানাচুর, অথবা পিকনিকের জন্য কর্মীদের সাথে বসে দেওয়া আড্ডা সব মনে থাকবে। মনে থাকবে অফিস থেকে ফেরার পথে একবার হাতিবাগানে শাড়ির দোকানে "রমার" জন্য কেনা...... ভাবতে ভাবতে সুব্রতর চোখ ঝাপসা হতে লাগল এক চিলতে ভালোলাগায়, সেই ভালোলাগা যা সে তিলতিল করে সঞ্চয় করেছে তার প্রতিটা "পে চেকে", সঞ্চয় করেছে তার টেবিলের ব্যস্ততায়, রঙিন ফাইলে আর............ আট তলার ৫ নম্বর সবুজ পর্দা দেওয়া ঘরে।

আর মাধবী? নাহ, আজ নয়, অন্যদিন বলব তার কথা...... ততক্ষণ এই ভালোলাগা গুলো জুড়ে থাক "আজ শেষ দিনে"...

ধন্যবাদান্তে,
সম্পাদক-নবপত্রিকা

No comments:

Post a Comment