Code

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

Second Header

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

Saturday, May 21, 2016

পিঞ্জর



তখন কোলকাতার রাস্তাঘাট একেবারে শুনশান। সকালের দিকে ঝিরঝিরে এক আধ পশলা হলেও, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়েছে মুষলধারে বৃষ্টি। একটা শিরশিরে ঠাণ্ডা ঝোড়ো হাওয়া আনমনে বয়ে চলেছে সর্বক্ষণ। ফুটপাথের দুই ধারে, রাস্তার ওপর হেলে আসা দূরের গাছগুলো মাঝে মাঝেই মাথা দোলাচ্ছে তার তালে তালে। আকাশের ঘনঘটায় চারদিক বেশ আবছায়া হয়ে এসেছে। থেকে থেকে আকাশের বুক চিরে নেমে আসছে গুরু গম্ভীর আওয়াজ। পাতার মড়মড় আর শনশন হাওয়ায় তখন আড়মোড়া ভেঙ্গে গভীর নিঃশ্বাসে নিস্তব্ধ শহরের ঘুম থেকে জেগে ওঠার গন্ধ। রাস্তায় লোক বলতে তেমন কারও দেখা মিলছে না। শুধু কয়েকটা কচিকাঁচার দল, যারা এই বর্ষাতেও "দস্যিপনা" করতে বেরিয়ে পড়েছে রাজপথে। আজ কারো চোখ রাঙ্গানি নেই, আজ শুধু মুক্তির আস্বাদ বৃষ্টির প্রত্যেক ফোঁটায় মেখে নেবার দিন। কখনও জল ছোঁড়াছুড়ি, কখনও দৌড় দিচ্ছে পাশের গলিতে। অনেকটা ঝাপসা হয়ে গেছে চারপাশ। দূরের দিকে কয়েকটা দোকান খোলা থাকলেও, আজ সপ্তাহের ছুটির দিন হওয়ায় বেশিরভাগেরই শাটার টানা , বা অনেকে সকাল সকাল বন্ধ করে বাড়ি ফিরে গেছে বর্ষার আমেজটুকু চেটেপুটে উপভোগ করার জন্য। রাস্তার দুই ধারে একটু জল জমেছে, পিচের রাস্তার পাশেই যেন ক্ষুদ্র স্রোতস্বিনী। মাঝে মাঝেই কিছু গাড়ি তীর বেগে বেরিয়ে যাচ্ছে একের পর এক, চারিদিকে জল ছিটিয়ে। আর তারই মাঝে শোনা যাচ্ছে একটা গুনগুন আওয়াজ। এক মানুষের কণ্ঠস্বর যা বয়ে আসছে ঝোড়ো হাওয়ার সাথে।

"তারে ধরি ধরি মনে করি, ধরতে গেলেম আর পেলেম না/ দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা..."

খুব পরিচিত সেই কণ্ঠস্বর এই এলাকায়। সেই বৃদ্ধ মাধুকর, এই বৃষ্টিতেও ভিজতে ভিজতে আপন মনে গেয়ে চলেছে গান, আর হেঁটে চলেছে অজানা গন্তব্যে। কোথায় তার ঘর কেউ জানে না, সকলে শুধু জানে তার মন ছুঁয়ে যাবার কথা। পুরনো ময়লা হয়ে যাওয়া একটা জামা, আর পিঠে একটা ঝুলি। শীর্ণ হাতের খঞ্জনীর তালে তালে গেয়ে উঠছে তার মন। আধপেটা বয়সের ভারে নুইয়ে পড়া চোখেমুখেও কেমন যেন প্রশান্তি, আর গাল ভরা হাসি নিয়ে আপন মনে মাথা দুলিয়ে গাইতে গাইতে বৃষ্টির মধ্যেই চলেছে ফুটপাথ দিয়ে। হয়তো "আজ অন্য এক দিন"।

অরুণ তখন বাস স্টপে বসে আছে, একলা। মেঘলা দিন খুব পছন্দ করে, অরুণ। ছোটবেলায় মায়ের কাছে অনেকবার বকুনিও খেয়েছে, যখন বিছানাতে বই ফেলে রেখে আনমনে চলে গেছে জানালার পাশে, আর ছোট্ট হাত দুটো বাড়িয়ে দিয়েছে বাইরে। সে যেন, শাসনে আবদ্ধ শিশুমনের একটুকু "হারিয়ে যাওয়ার মুহূর্ত"। আঙ্গুলের ফাঁক বেয়ে জলের বিন্দুগুলো নেমে এসেছে তার কাছে, কল্পনার রেখাচিত্র হয়ে। জানালার লোহার গ্রিলে নরম গাল ঠেকিয়ে তাকিয়ে থেকেছে আকাশের দিকে, শুনেছে তার মৃদুমন্দ গুঞ্জন। দেখেছে তার বজ্রগর্ভ চোখ রাঙ্গানি। স্কুল ফেরত বহুবার থেমে গেছে মাঝরাস্তায় সেই "অপার্থিব" ঘটনা চাক্ষুষ করার জন্য। দুহাত বাড়িয়ে চোখ বুঝে খিলখিলিয়ে হেসে উঠেছে বাঁধ ভাঙ্গা বৃষ্টির মাঝে। কতবার ছোট্ট অঙ্কের খাতা নিয়ে বসে, আনমনে তাকিয়ে থেকেছে সূর্যের মেঘের আড়ালে লুকিয়ে যাবার মুহূর্ত দেখার অপেক্ষায়। সেও যেন ছিল এক অন্য ভালোবাসা।

কিন্তু আজ অরুণ অনেক বড় হয়ে গেছে, বৃষ্টির প্রতি তার "সেই শিশুসুলভ" ভালবাসার পরিবর্তন হলেও, আজ যেন তা ফিরে এসেছে 'এক অন্য দিন' হয়ে। রেনকোট গায়ে বসে আছে সেই বাস স্টপে, একটা ট্যাক্সির অপেক্ষায়। পাশেই ট্যাক্সি স্ট্যান্ড কিন্তু কারো যেন দেখা মিলছে না। তাই স্টপেজেই নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে সে। দু একটা ট্যাক্সি দ্রুত গতিতে পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাবার সময়, স্টপেজে ট্র্যাভেল ব্যাগ সমেত বসে থাকা সেই একলা যাত্রীর দিকে হর্নের আভাস দিলেও, অরুণ কোনও সাড়া দেয়নি। আনমনে বসে থেকেছে পায়ের দিকে চেয়ে, ঠিক যেখানে মেঘালি হাওয়ায় বয়ে আসা বৃষ্টির ছোট ছোট বিন্দুগুলো মুক্তোর দানার মত তেলা চাতালের ওপর ছড়িয়ে পড়ছিল, মাথা কুটে মরছিল তার পায়ে একবার তাকিয়ে দেখার জন্য। কিন্তু অরুণ আজ যেন অন্ধ এই সব কিছুর প্রতি। তার চোখ তখন আর্দ্র, জলে ভারী। সব কিছু ঝাপসা হয়ে গেছে তার সামনে। কোনও শব্দ, কোনও ঘটনাই যেন তাকে নাড়া দিচ্ছে না। রেনকোট থাকলেও প্রায় সম্পূর্ণ ভিজে গেছে এইভাবে বসে থেকে। মুখে চিন্তার ছাপ, যখন বৃষ্টির জল তার কপাল চুইয়ে নেমে আসছে কানের পাশের রগ বেয়ে। উস্কখুস্ক ভেজা চুলের নির্যাস তখন বলিরেখার মত খুঁজে নিচ্ছে পথ তার ঠোঁট বেয়ে। সুঠাম চিবুক বেয়ে টিপ টিপ করে পড়ছে পায়ের ওপর, যখন সব হারিয়ে যাবার লজ্জায় মূক হয়ে গেছে, নামিয়ে নিয়েছে মাথা। খোঁচা হয়ে যাওয়া দাড়িতে যেন তাকে আর বেশি ভঙ্গুর দেখাচ্ছে, যখন বারে বারে সে নিজের কাছে প্রশ্ন করে চলেছে, "কেন এমন হল?" একটা চোরাবালির টান যেন রয়ে গেছে, যেটা তাকে দুহাতে আঁকরে ধরে রয়েছে; তার জাল ছিঁড়ে বেরতে চাইছে, কিন্তু পারছে না- পারছে না ভুলে যেতে এতদিনের কাউকে পাশে পাওয়ার অভ্যাস। ভুলতে পারছে না এতদিনের "কাছাকাছি" থাকার স্মৃতিগুলো। হয়তো নিজের ভাগ্যকে দুষে চলেছে, কেন "তার" সাথে দেখতে দেখতে হয়ে গেল এতটা সময়। "স্মৃতি"- কথায় আছে, একটা মানুষ নাকি অন্যের মধ্যে বেঁচে থাকে চিরকাল তার স্মৃতিগুলোর মাধ্যমে। সময়ের ভিড়ে, মানুষ হারিয়ে গেলেও, "স্মৃতিগুলো" তো মনের বন্ধ দরজার পেছনে বারে বারে কড়া নেড়ে যায়- কি করে কেউ রুখবে তাকে?

মাধবীর বাড়িতে আজ একটু সাজ-সাজ রব। পাত্রপক্ষের লোক এখন কেন এসে পৌঁছালো না সেই নিয়ে তার বাবার উদ্বেগ কম নয়। কিছুদিন আগেই একটা "ভাল" সম্বন্ধ এসেছে। মেয়ের "সম্মতি" নিয়েই টাই এই প্রস্তুতি। আজ তারা দেখতে আসছে তাঁর মেয়েকে প্রথমবার। তার সাথে আবার এই মুষলধারে বৃষ্টি। এইকটা দিন বেশ রোদ ঝলমলে থাকলেও গত পরশু থেকে বেশ বৃষ্টি শুরু হয়েছে, থেকে থেকে। আর আজ সকাল থেকে যেন তা প্রবল আকার নিয়েছে। বাড়িতে লোকজনের আনাগোনা, আত্মীয় স্বজন মিলে তখন বাড়ি বেশ সরগরম। প্রস্তুতির এতটুকুও খুঁত রাখতে চান না সরকার মশাই তাঁর একমাত্র মেয়ের জন্য। একটু চিন্তায় আছেন বটেই, মাঝে মাঝে সহধর্মিণীর কাছে জেনে নিচ্ছেন "আয়োজনে আর কিছু লাগবে কিনা।" কখনও ঘন ঘন ফোন, কখনও অতিথি আদর, কখনও বা একটু ধমকের সুরে "আরে মাধু কে তৈরি হয়ে নিতে বলও, আর কতক্ষণ লাগাবে? এই! তোমাদের কাউকে পাঠাও না ওকে সাজিয়ে দেবার জন্য।" উনি শশব্যস্ত হলেও, মাধুর মা জানতেন তাঁর মেয়ের মনের অবস্থা। হাজার হোক মা তো! এইটুকু নিশ্চয় আঁচ করতে পেরেছিলেন এতদিনে।

উপরের দোতলার ঘরে তখন একলা বসে মাধবী। ডানদিকের জানালা খোলা, আর বৃষ্টিতে মেঝের অনেকটা অংশ ধুয়ে যাচ্ছে। জানালার পর্দাগুলো অনেক আগেই ভিজে গুটিয়ে গেছে, কিন্তু ঝোড়ো হাওয়ার সাথে সেটাও উড়ে চলেছে মাতালের মত। কোনও খেয়াল নেই সেইদিকে, বরং "সম্পূর্ণা" হয়ে ওঠার মুহূর্ত টুকু অনুভব করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে, কিন্তু যেন পারছে না। সবকিছু থেকেও জেনো কিছু নেই। আয়নার সামনে বসে আসছে স্থবিরের মত, আর নিরন্তর ভেবে চলেছে "ঠিক আর ভুলের" হিসাব। নতুন শাড়ি যখন তার "নারী" হয়ে ওঠার অহংকারকে জড়িয়ে রেখেছে, যখন কানের দুল ঝোড়ো হাওয়ায় ছুঁয়ে যাচ্ছে তার উষ্ণ গাল, যখন সদ্য স্নাত চুলে এলিয়ে এসেছে বুকের মাঝে, যখন গলায় পড়েছে নতুন সোনার অলঙ্কার, যখন হাতে পড়েছে নতুন সোনার বালা- তখন সব কিছু যেন তার কাছে পায়ের বেড়ির মত হয়ে গেছে- মাধবী যেন নিজেকে চিনতে পারছেনা । খুব অচেনা লাগছে নিজেকে সেই মেয়েটার থেকে, যে বৃষ্টির দিনে একলা ছাদে গেয়ে উঠত "মায়াবন বিহারিণী"। আয়নার সামনে নিজের চোখের দিকে তাকিয়ে বারেবারে প্রশ্ন করেছে, কেন তারা দুজন "কাছাকাছি" হয়েই রয়ে গেল; কেন একটা সম্পর্কের রূপ নিল না। নাকি এটা শুধুই মনের ভুল, হয়তো মাধবীর এই মুহূর্তে "বন্ধুত্বের" নামে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া একটা অধিকারবোধের কাছে মাথা নত করার কোনও ভাবেই উচিত না, বরং তাকিয়ে দেখা উচিত আগামীর দিকে। নতুন সম্পর্কের দিকে। যে স্মৃতি তাকে বার বার ছুঁয়ে যাচ্ছে, সেই "সঙ্গে থাকা"টা হয়তো নিছক কিছু ঘটনা, যা সত্যিই সুন্দর, কিন্তু জীবনের সঙ্গে চলার জন্য যথেষ্ট নয়। যথেষ্ট নয় কাউকে চলার পথের সঙ্গী হিসাবে মেনে নেওয়ার। হতেও পারে, মাধবী কোনদিনও সেইভাবে অরুণকে ভেবে দেখেনি। তবুও আরেকবার ভেবে দেখতে চাইছিল মাধবী, আপ্রাণ চেষ্টা করছিল এটা বোঝার "কোনও ভুল করে ফেলছি না তো?"। "শেষ থেকে শুরুর" মত এত কিছুর মধ্যেও তার কাছে ফিরে আসছিল সেই গল্পের প্রথম পাতার কথা।

"কাছাকাছি"- অনেকটা এই শব্দের মতই ছিল একটা সম্পর্ক। নাহ, "প্রেম" বা "বন্ধুত্ব" এই দুটো শব্দের মধ্যে কোনটাই হয়তও ওদের দুজনের জন্য উপযুক্ত ছিল না। ওদের "গল্পের" সূত্রপাত অনেক বছর আগে। তখন কোলকাতায় সবে কম্পিউটার চালিত কিছু নতুন "কোম্পানি" অফিস খুলেছে বিডন ষ্ট্রীটে। প্রধানত হংকং ব্যঙ্ক তাদের প্রথম শাখা খুলল খাস উত্তর কোলকাতার বুকে। সেই সূত্রে সরকার পরিবারও চলে এলেও কোলকাতায়, ৫ নম্বর বেনিয়াটোলা ষ্ট্রীটের বাড়িতে। নতুন পরিবেশ, নতুন শহর। আদি বাড়ি ছিল বহরমপুরে, কিন্তু চাকরির সূত্রে সেখানকার ভিটেমাটিকে একপ্রকার বিদায় জানিয়ে চলে এসেছিলেন সুশীল বাবু। সঙ্গে স্ত্রী আর তাঁর একমাত্র মেয়ে। ছোট সংসার। মাধবী, অর্থাৎ আদরের "মাধু" ভর্তি হল কাছের "সরস্বতী বালিকা বিদ্যালয়ে"। মেয়ে তখন সবে সবুজ শাড়ি পড়া শিখেছে। স্কুল যাবার আগে এলো চুলে মাঝে মাঝে থমকে যেত আয়নার সামনে, একলা ঘরে। কৌতূহল নিয়ে নিজেকে স্পর্শ করে দেখতে চাইত, বুঝতে পারত সে নিজে "নারী" হয়ে উঠছে।

প্রথম প্রথম অত কারও সাথে কথা বলার ছিল না। দেখতে দেখতে একটা বছর কেটে গেলেও, মাধু পাড়ায় বিশেষ কারও সাথে মিশত না। সঙ্গী বলতে স্কুলের কয়েকটা মেয়ে, যদিও তাদের কেউই এই পাড়ায় থাকতো না। বলতে গেলে "কথা বলার" দুনিয়াটা মাধুর জন্য খুবই ছোট ছিল। ছুটির দিনে একলা দুপুর কাটত বই পড়ে, গান শুনে, কখনও বা বুড়ো হারমোনিয়ামের সাথে নিজের মনে গুনগুন করে- সামনে রাখা গানের স্বরলিপি। তার পড়ার ঘরে থরে থরে সাজানো নানান গল্পের বই। তার গল্পের দুনিয়া জুড়ে ছিল রহস্য রোমাঞ্চ রূপকথা আরও কত কি। কিন্তু গল্পের দুনিয়ার বাইরেও যে একটা বিরাট চলমান পৃথিবী আছে সেটা সম্পর্কে তার ইচ্ছে বা অনুরাগ কোনটাই ছিল না তেমন। তবে "অনুরাগ" ততদিন পর্যন্ত অধরা ছিল, যতদিন না তার দেখা হয়েছিল সেই "ছেলেটার" সাথে।

শৈলেন্দ্র সরকার বয়েজ স্কুলের গেট। অন্যদের মত, এই পথ দিয়েই মাধবীরও নিত্যদিনের যাতায়াত ছিল। সবুজ শাড়ি পড়ে যখন বাকি বান্ধবীদের সাথে সে ফিরত বাড়ি, হয়তও অনেক ছেলেই অপেক্ষায় বসে থাকত ছুটির বেলায় তার একবার দেখা পাওয়ার জন্য। কিশোর প্রেম যেমন হয়। তখন কাছাকাছি একটা গার্লস স্কুল মানে বিকেল হলেই মন উরু উরু। শেষ দিকের ভূগোল বা অঙ্কের ক্লাস থাকলে মোটামুটি সব কিছু মাথার উপর দিয়ে যেত। স্কুলের ঘণ্টার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত মন। ঘণ্টা বাজা মানেই পকেট থেকে লুকিয়ে বাড়ি থেকে আনা চিরুনির উল্টো আঁচড়, মুখে একটু জলের ঝাপটা। এর গেটের বাইরে গিয়ে চুপটি করে কোনও শান্ত গাছের তলার দিকে অপেক্ষা করা, "তাদের" আসার অপেক্ষায়। অরুণ কিছুতেই মন বসাতে পারত না শেষ দিকের পিরিয়ড গুলোতে। তখন আর হাফ প্যান্ট নেই। মাধমিকের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, সটান টান টান কালো প্যান্ট আর বুট জুতো। স্কুল ব্যাগ এক্কেবারে "না না"। একটু স্টাইলিশ বেল্ট ব্যাগ বা সাইড ব্যাগ ছিল তার প্রথম পছন্দ। সেই তো "বড়" হয়ে উঠছিল মনে মনে। তাই প্রেমটাও এসেছিল যেন স্বাভাবিক নিয়মে। অরুণকে পাড়ায় ক্রিকেট খেলতে অনেকবার লক্ষ্য করেছে, মাঝে মাঝে দু একবার বল কুড়োতে এসে পাশের বাড়ির কাকিমার কাছে "ঝাড়ও" খেয়েছে। আর হ্যাঁ আরও লক্ষ্য করেছে, যখন বাবার হাতে উদোম ঠ্যাঙানি খাবার পরে বাড়ির বাইরের রকে মুখ গোমড়া করে রাত অবধি বসে থাকতে। কোনদিনও কথা হয়নি এক বিকেলের আগে পর্যন্ত।

বাসস্টপে বসে অরুণের মনে পড়ছিল, "যদি সেদিন চিঠিটা সত্যিই প্রাপকের হাতে পৌঁছাত, হয়তো এই গল্প অন্য খাতে বইত।" ব্যাগটা ভিজে যাচ্ছে দেখে একটু পিছনের দিকে টেনে রেখে দিল। ঘড়িতে তখন বাজে তখন বেলা তিনতে। সন্ধ্যের ফ্লাইটে আজ চেন্নাই যাবার কথা অরুণের। অনেকটা লম্বা সময়ের জন্য বিদায় জানাতে চলেছে তার শহরকে, আর তার সমস্ত ফেলে আসা মুহূর্তকে। অরুণের মনে পড়ছে, "সেদিনও বিকেল ছিল"। সূর্যাস্তের শামিয়ানা নেমেছিল দুটো "ছেলেমেয়ের" প্রথম কথা বলার জন্য। অরুণের সেদিন স্কুল থেকে বেরোতে একটু দেরী হয়ে গেছিল। মাধ্যমিকের প্রস্তুতি ক্লাস চলছিল স্কুলে। এদিকে মাধবীদেরও তখন উচ্চ মাধ্যমিকের তোরজোড় চলছে। একটু আলো কমে এসেছিল। "তার" সাথে দেখা হবে না এই ভেবে, স্কুল থেকে বেরিয়েই সাইকেলে করে রওনা দিল বাড়ির দিকে। যদি ফেরত যাবার পথে "তার" সাথে দেখা হয়। দূর থেকে দেখতে পেল মাধবীও তার বান্ধবীদের সাথে গল্পে মশগুল, রাস্তা দিয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছে। খুব জোরে চালাচ্ছিল প্যাডেল। চোখের সামনে ছিল সবুজের আবরণে বেড়ে ওঠা সেই মেয়েটা। সামনের মোড়টা ঘুরে, তাদের সামনে ব্রেক কষতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল রাস্তায়। হাতটা গেল ছড়ে। ব্যাগ তখন রাস্তায় লুটোচ্ছে। মাধু একটু চমকে গেলেও পরে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে বাকি বান্ধবীদের সাথে। এমন আজব "ছেলেপুলেও" আছে তাহলে! মাধু জানত কি কারণে অরুণ তার পিছু নিয়েছে, কিন্তু সেদিন জানতে পেরেছিল "সত্যি" কারণটা। কোনরকমে প্যান্ট ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সোজা মাধবীর সামনে। তার এক বান্ধবী একটু কড়া সুরে বলল, "কিরে? কি হচ্ছে এইসব? রাস্তা আটকে বদমায়েশি?"। মাধবী অতটা বিরক্ত হয়নি, বরং একটু মৃদু হেসে বলল, "দাঁড়া কুসুম, ও আমাদের পাড়াতেই থাকে। মনে হয় কিছু বলতে চায়"।
"কি আর বলবে? সেই তো..." একটু বাঁকা উত্তর দিল তার বন্ধুরা।

অরুণ একটু কটমট করে তাকালও মাধুর বন্ধুদের দিকে, তারপর পকেট থেকে একটা চিঠি বার করল। সটান মাধবীর দিকে বাড়িয়ে দিল।

"এটা কি? মনে আছে তো, তোমার মা বাবা জানতে পারলে কি হবে? স্কুল যাবার নামে পাকামো? জানও নিশ্চয়, আমি তোমার থেকে দুই ক্লাস ওপরে পড়ি?" মাধবী একটু মেকি বিরক্তি দেখাল। একটু ধমক দিতে চাইল এই "বেয়ারাপনায়"। যদিও মনে মনে একটু দুষ্টুমি অনুভব করছিল। স্কুল বয়সে এই রকম আকছার হয়ে থাকে।

অরুণ কথা না বাড়িয়ে বলল, "কিছু মনে করো না। এটা তোমার জন্য নয়। তোমাদের স্কুলে সুস্মিতা বলে একজন আছে। তোমাদের সাথেই মাঝে মাঝে ফেরে। ইদানীং আর দেখতে পাইনা। তুমি আমাদের পাড়ায় থাকো। পাড়ার মধ্যে কেউ কিছু জানতে না পারে, তাই স্কুল ফেরার পথেই ভাবলাম বলব। আজকেও তার অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু সে আজও তোমাদের সাথে ফেরেনি। তাই এই চিঠিটা..."

মাধবী তখন এক্কেবারে চুপ এবং হতবাক। মনে মনে ভেবেছিল আর সকলের মত এই ছেলেটাও হয়তও নেহাত তার প্রতি একটা টান অনুভব করেছে। তাই এমন স্কুল ফেরত রাস্তার মাঝে থামিয়ে কথা। কিন্তু অরুণের কথাগুলো শোনার পর তার ভুল ভেঙেছিল। সব ধারণা তো সব সময় সত্যি হয়না। সেদিনও হয়নি। একটুর জন্যে হলেও ঈর্ষা করেছিল সুস্মিতার জন্য।

"আমি অনেকবার কথা বলার চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি। প্রতিবেশী হিসেবে তুমি যদি একটু সাহায্য করো, তাহলে ভাল লাগবে। আর কিছু না। যদি দেখা হয় তাকে এইটা দিয়ে দিও। নাহলে ছিঁড়ে ফেলে দিও।"

একলা এমন মুহূর্তেও, কেন জানা নেই, অরুণ এত কিছুর মধ্যেও একটু হেসে ফেলল, এমন রোমন্থনের সময়। ফিরে এল বাস্তবের মাটিতে। সময় থেমে থাকেনা। তাকে চলে যেতেই হবে, মেনে নিতেই হবে "আর ফেরার পথ নেই"। একটু যেন খেয়ালে হারিয়ে ছিল, কিন্তু ঘোর কাটল একটু বাদে, রিস্টওয়াচের অ্যালার্মে- অনেকক্ষণ ক্রমাগত বেজে চলেছে। চোখের জল কখন যেন বৃষ্টির সাথে মিশে গেছে। মুখ মুছে উঠে পড়ল, "এটাই সত্যি" ধরে নিয়ে। অরুণ জানেনা, মাধবী এই মুহূর্তে কেমন ছিল। আদৌ তার এই নীরবে চলে যাওয়ার মধ্যে মাধবীর জীবনে কোনও ফারাক আদৌ পড়বে? কিন্তু পর মুহূর্তে নিজেকে বুঝিয়েছে, "নাহ! নিজেকে হয়তো অতটা বিশ্বাসী করে তুলতে পারেনি আমি তার কাছে। হয়তো বন্ধুত্বটাই সে আমার কাছে চেয়েছিল, এর থেকে বেশি কিছু নয়। হয়তো একসাথে বেড়ে উঠেছিলাম বলেই একটা নির্ভরতা তৈরি হয়েছিল, যেমন হয়ে থাকে সবার মধ্যে। সেটা থেকে একটা সম্পর্কের আশা করা, হয়তো একটু তার অধিকারে হস্তক্ষেপের মত ছিল। হয়তো আমি ভুল ছিলাম, ভুল ভেবেছিলাম তার এভাবে কাছে আসার মধ্যে। কিন্তু সেও তো সংযত হতে পারত। হয়তো আমি এতদিনের পাশে থাকাটাতে অনেক বেশি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি, তাই এমন অসহায় মনে হচ্ছে। হয়তো আমিই তাকে আমার অধিকার বলে মেনে নিতে চেয়েছি, তার স্বাধীনতা নিজের কাছে ধরে রাখতে চেয়েছি। স্বার্থপর! আমি স্বার্থপর!" নিজের ওপর ঘেন্না হচ্ছিল অরুণের। হয়তো অরুণের প্রেম মাধবীর কাছে "পিঞ্জর" হয়ে গেছিল, হয়তো এই বন্ধুত্বকে ভালবাসার শিকলে না বাঁধতে চাইলেই ভাল ছিল। তাহলে এভাবে দুজনকে আলাদা হয়ে যেতে হত না। আসলে একে অপরের "মানসিকতা" জেনে ফেলার পর আর কখনও সম্ভব আগের মত সব কিছু চলার? কখনও সম্ভব স্বাভাবিক হবার, যখন মনে মনে একজন জানে আরেকজনের তার প্রতি অনুভুতির কথা। "এটাই ভাল হল। একটা গল্প শেষ না হলে হয়তো অপরটার শুরু হয়না।"

"ট্যাক্সি, ট্যাক্সি", জোরে হাঁক পাড়ল একটা গাড়ির দিকে, কিন্তু সেটাতে মনে হয় যাত্রী ছিল, তাই থামল না, বেরিয়ে গেল তীর বেগে।

মাধবীর বাড়িতে তখন সদ্য খবর এসেছে, পাত্রপক্ষের লোকজন আর কিছু ক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বে। মা খানিক আগে এসে আগল ঠেলে বলে দিয়ে গেল, "মাধু, যা হবার হয়ে গেছে। এভাবে বসে থেকে লাভ নেই। যা করিস, ভেবে চিনতে করিস। আর সময় নেই"। মাধবীর কাছে সেটা অনেকটা অন্তিম মুহূর্তের মত ছিল। আর মাধবীর মায়ের কাছে সেটা অনেকটা পরীক্ষার মত হয়ে যাচ্ছিল। কারণ গত রাতেই যে মেয়েটা সব কথা বলে ফেলেছে তার কোলে মাথা রেখে, যখন চোখের জলে ভিজে গেছে মায়ের আঁচল। নাহ! এটা ভুল যে মাধবীর বাড়ি থেকে কোনও চাপ এসেছিল বিবাহের জন্য, অথবা কোনও বাধা এসেছিল অরুণকে "না" বলার জন্য। বরং একরাশ দ্বিধা নিয়ে মাধবী মায়ের কাছে জানতে চেয়েছিল, তার সিদ্ধান্ত ঠিক কিনা। একটা মানুষ যখন ধীরে ধীরে আশঙ্কা আর সবকিছু হারিয়ে যাওয়ার গ্রাসে চলে যেতে থাকে, তখন খড়কুটোর মত আঁকরে ধরতে চায় আপন কাউকে। তাই "সাবালিকা" হয়েও, মায়ের হাত চেপে ধরে জিজ্ঞেস করেছিল, "মা, আমি তো ওকে বন্ধুর মত দেখেছি, এর বাইরে..." কথা থেমে এসেছে, কিন্তু ঠোঁট মুছে আবার বলেছে, "কিন্তু আমি তো ওকে হারাতে চাইনা।" হায় অমোঘ বিধাতা! এই মেয়েটা আজও বুঝে উঠতে পারেনি, "পৃথিবীতে সব সম্পর্কেরই নাম দিতে হয়"- আর এইটার বাইরে কিছু হতে পারেনা। মাধবীর কাছে অরুণকে হারানো একটা বড় আঘাত ছিল, কারণ সে নিজেও বুঝে উঠতে পারেনি অরুণ তার মনের ঠিক কতটা জায়গা আলো করে রেখেছিল। খেলায় খেলায় সত্যিই কি সে অরুণকে ভালবেসেছিল, নাকি শুধু বন্ধুর মত মিশতে চেয়েছিল তার সাথে। কেনই বা সে এত বিহ্বল একজনের চরম সিদ্ধান্তের প্রতি। কেনই বা আজ বাড়িতে "আগমনের" প্রস্তুতি, এ সবই তো তার ইচ্ছায়- বা বলা উচিত এর কোনোকিছুতেই তো তার কোনও "না" ছিল না। মায়ের পাশে শুয়ে রাতভোর ভেবেছিল সেই "প্রথম ভুলের" কথা- হ্যাঁ সেই চিঠিটা। ভাবতে লাগল সেই চিঠিটার কথা যেটা অরুণ দিয়েছিল তার হাতে।

চিঠিটা হাতে নিয়ে মাধবী একটু আনমনে ভাবছিল; অরুণ কিন্তু সেটা দেবার পর এক মুহূর্ত দাঁড়ায়নি। সাইকেল তুলে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে দ্রুত গতিতে বেরিয়ে গেছিল। শুধু একবার পিছন ফিরে তাকিয়েছিল মাধুর মুখের দিকে। এমনও হয় তাহলে। চিঠিটা লুকিয়ে রেখেছিল অঙ্কের বইএর মাঝে। "লেট নাইট স্টাডি" এই অজুহাতে একটু একান্ত সময় খুঁজে নিয়েছিল রাতের আঁধারে, যখন সবাই ঘুমিয়ে গেছে। পড়ার টেবিলে লাইট জ্বেলে মন দিয়ে পড়েছিল সেই "গোটা গোটা" শব্দে লেখা চিঠি। এমন নয় যে এই রকম কোনও চিঠি সে প্রথম বার পড়ছে, কিন্তু সত্যি বলতে প্রথম বার "অন্যের" চিঠি পড়ছে। একটু দ্বিধা থাকলেও, সেই চিঠি পড়ার লোভ সামলাতে পারেনি। আর যতই পড়েছে, নিজের মনে হেসেছে বারংবার। একটু হাতের লেখার সমস্যা ছিল অরুণের কিন্তু তার লাইনে লাইনে ছিল, সুস্মিতাকে প্রথম দেখা থেকে পাওয়া সমস্ত অনুভূতি। না কোনও প্রেম পত্র নয়, এক্কেবারেই নয়। বরং হয়তও সুস্মিতার অলক্ষেই অরুণ আবিষ্কার করেছিল তাকে নানা মুহূর্তে দেখার "ভাল লাগা"। স্কুলের শেষ পিরিয়ডে আনমনা হয়ে যাওয়া থেকে অঙ্কের ভুল উত্তর দেওয়া, ফুচকার দোকানে দাঁড়িয়ে কথা বলার সময় তার ঠোঁট চুয়িয়ে ঝড়ে পড়া হাসি, গাছের তলায় দাঁড়িয়ে তার জন্য অপেক্ষা শুধু একবার দেখার জন্য, মুখ ফুটে সামনে এগিয়ে কিছু বলতে না পারার কষ্ট, কিম্বা একলা কোনও বৃষ্টির দিনে শুধু তার জন্য লেখা কবিতা। সব ছিল তার সেই দু পাতার কথায়। কোথাও একবারের জন্যেও "ভালবাসা" নিয়ে কথা লেখেনি। শুধু বর্ণনা করেছে সেই রূপসীকে যে দিনে দিনে সুস্মিতা হয়ে উঠেছিল তার চোখে। আশ্চর্যের কথা হল, মাধবী এমন চিঠি কোনও দিন পায়নি, পেলে হয়তও তার ভাল লাগত। তার দুনিয়াটা অনেকটা ছোট, হয়তও তার নিজের কুণ্ঠা বা দ্বিধার জন্য। সেখানে কোনও মানুষের আগমনের পথটা খুব সঙ্কীর্ণ। কিন্তু অরুণ যেন কিভাবে বেখেয়ালে সেই দরজায় কড়া নেড়েছিল। মন বসেনি মাধবীর সেদিন আর পড়ায়। পাশ বালিশ বুকের খুব কাছে টেনে এনে শুয়ে পড়েছিল বিছানায়। চুলের ভাঁজে ক্লিপ লাগিয়ে পা দুটো খেলাচ্ছলে নাড়াতে নাড়াতে বারংবার পড়েছিল সেই লেখা। হোক তা অন্য কোনও মানুষের জন্য, কিন্তু নিজেকে তার জায়গায় ভাবতে দোষ কি?

"ব্যকরনে সমস্যা আছে, আর হাতের লেখা আরেকটু ভাল করতে হবে। তবেই চিঠি দেওয়া যাবে। আমি সুস্মিতার সাথে কথা বলেছি একবার। ও পরীক্ষা নিয়ে চাপে আছে, তাই এই মুহূর্তে কিছু তেমন সম্ভব নয় দেখা বা কথা বলার।" মাধবী চিঠি ফেরত দিল অরুণকে। কোচিং থেকে ফেরার পথে দেখা দুজনের একদিন সন্ধ্যাবেলা। অরুণ একটুও অবাক হয়নি এটা শুনে। সে জানত যে মাধবী সেই লেখা পড়বে। কিন্তু তাতে তার বিন্দুমাত্র কিছু এসে যায়না। বরং সুস্মিতার কাছে পৌঁছে দেবার উদ্যোগে সে যে সাহায্য করেছে, এজন্য খুশি হয়েছিল। হয়তও এটাও ছিল একটা নতুন পথ চলার শুরু। একটা "কাছাকাছি" আসার সূত্রপাত।

গতকাল রাতে, অন্দরে অন্দরে নিজেকে প্রশ্ন করেছিল তার নিজের ভূমিকার কথা অরুণের জীবনে। অরুণ কি কোনও অস্বাভাবিক কিছু চেয়েছিল তার "সব চেয়ে কাছের মানুষের থেকে?" । মনে পড়ছিল, গত দুমাস আগের সেই দোলের দিনের কথা।

"মাধবী আছে?"

"এই অরুণ এসেছে রে মাধবী। যাও ওপরেই আছে", মাধবীর মা তখন হেসে বললেন। একটা লাল পাড় নতুন শাড়ি পড়ে আছেন। হাতে তাঁর আরতির থালা, সকাল সকাল ঘরে ঘরে গঙ্গাজল দেবার পর, এইবার একটু ফলমূল কেটে ফাগের পূজোর প্রস্তুতি শুরু করছেন। অরুণকে কথাটা বলেই ভেতরের পূজোর ঘরে চলে গেলেন "আমি আসি, তুমি চলে যেও না যেন কিন্তু, আমি প্রসাদ দেব"।
"না না, কাকিমা, আমি থাকব।" অরুণ আশ্বস্ত করল তাঁকে। পরনে তখন ধবধবে সাদা পাঞ্জাবী, যার বামদিকে কিছু সুন্দর জলরঙের ছবি। সঙ্গে একটা গাঢ় নিল জিন্স। পাঞ্জাবীর হাতাটা খাটো করে গোটানো কনুই অবধি। হাতে মাধবীর দেওয়া শেষ জন্মদিনের ঘড়ি- সোনালী রঙের যেটা অনেকটা বাঁধনের মত জড়িয়ে রেখেছে তার প্রত্যেক নাড়ির স্পন্দন। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময়ে মনে মনে ভাবতে লাগল কিভাবে কথাটা বলবে, যেটার জন্য সে এতদিন অপেক্ষা করে আছে। ওপরের তলায় তখনও দরজাটা অর্ধেক ভেজানো আছে। ঘরের মধ্যে থেকে একমুঠো আলো এসে পড়েছে সিঁড়ির ওপর। কাছাকাছি আসার পর অরুণ একটু থমকে গেল। বারেবারে অনুধাবন করার চেষ্টা করছে, মাধবী ঠিক কতটা আনন্দ হবে সেই কথা শুনে। যদিও এটা প্রথম মুহূর্ত নয়, অরুণ তাকে কিছু কিছু কথার মাধ্যমে আভাস দিয়েছে। কিন্তু আজ সেই "সবার রঙে রঙ মেলাবার দিন"। জিনসের পকেট থেকে ধীরে ধীরে বের করে আনল আবিরের ঠোঙা, তাতে আবিরের গুঁড়ো, আর দুহাত ভরে নিল তার রঙে। হাত দুটো পিছনে লুকিয়ে, আসতে আসতে এসে দাঁড়ালো দরজার কাছে। মাধবী তখন আয়নার সামনে। নিজেকে অনেক পরিপূর্ণ লাগছিল। তার একটা অন্য কারণও আছে, আজ "দোল"। আর অরুণ বলেছিল আজ সারাটা দিন সে কাটাতে চায় তার সাথে। সাদা সালোয়ার কামিজ পড়ে তৈরি হয়ে নিচ্ছিল সকালের "ফাগ পূজোর" জন্য। আগেই শুনতে পেয়েছে মায়ের ডাক, অরুণ যখন এসেছিল। দরজার কাছে "খুট" শব্দ হতেই তাই সাদা ওড়নাটা লজ্জায় জড়িয়ে নিল নিজের ওপর। কিছু না বলে একটু মৃদু হাসতে হাসতে মাথাটা হেলিয়ে দিল, আয়নার সামনে রাখা কানের দুলটা তুলে নিল হাতে। আর তার চুলের গহন অরণ্যের মধ্যে আঙুলের আলতো ছোঁয়ায় দুলিয়ে দিল সেটা নিজের কানে। সকালের রোদ তখন জানালার আরশি বেয়ে সোনালী রং হয়ে বয়ে যাচ্ছিল ওর আধ ভেজা ত্বকের ওপর। হাতের নতুন কাঁচের চুড়ির টুংটাং। একটু খেলাচ্ছলেই নাড়িয়ে নিচ্ছিল নিজের মনে মনে একটু "সেই" অনুভূতি পাবার আনন্দে। কাজলের হালকা রেখায় তখন তার চোখে হয়ত ঈশান কোণের মেঘবেলা। আজ যেন একটু দুষ্টুমি করেই পড়ে নিয়েছে নাকের নথ। সচরাচর কোনদিনও পড়েনা, লুকিয়ে রাখে। কিন্তু আজ যেন তার মন চাইছিল। রূপোলী নথ যখন তাকে "সম্পূর্ণা" করে তুলছিল, তখন তার রক্তিম ঠোঁটে ছিল আগুন।

একবার পিছন ফিরে তাকালও দরজার দিকে, একটু আশ্চর্য হয়ে। এতক্ষণে অরুণের ভেতরে চলে আসার কথা। কিন্তু হয়তও অরুণ একটু সময় নিচ্ছিল মাধবীর তৈরি হবার জন্য। মাধবীকে পিছনে ফিরে তাকাতেই একটা যেন সম্মতি পেল। হাত দুটো পিছনে রেখে ধীর পায়ে ঢুকে এলো ভেতরে। মাধবী আবার আয়নায় নিজেকে দেখতে লাগল। আর তার প্রতিফলনে দেখতে থাকল অরুণের এগিয়ে আসা। অরুণের যেই হাতদুটো সামনে নিয়ে এলো, মাধবী দেখতে পেল তার হাত ভর্তি রং, ঝড়ে পড়ছে গুঁড়ো হয়ে। চকিতে বুঝতে পেরেই আয়নার সামনে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল খিলখিল করে হেসে, "এই না! একদম না, অরুণ। আমার এখনও পূজো দেওয়া হয়নি।"

অরুণ শুধু হেসে চলেছে, যখন মাধবী তফাতে গিয়ে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করছে। সোফা থেকে বালিশটা ছুঁড়ে মারল অরুণের দিকে, তার থেকে বাঁচবার জন্য। কিন্তু অরুণ তার এক হাতের মুঠো খুলে দিল একরাশ আবিরের রঙে। লাল হয়ে গেল মাধবীর ওড়না, কিছু বুঝে ওঠার আগেই, অরুণ তার হাত ধরে টেনে নিল কাছে। অরুণের জোর অনেক বেশি ছিল, অথবা হয়তও মাধবী বিরোধ করতে চায়নি। তবু শেষ মুহূর্তে হাত ছাড়িয়ে আবার পালাবার চেষ্টা করল, "ছাড়ও তুমি... মা কে বলে দেব..." । কিন্তু অরুণ যখন আবার ধরতে গেল মাধবীর আঙুল, রং মাখানোর আবদারে , তার হাতের কাঁচের চুড়ি চুরচুর হয়ে ভেঙে পড়ল মেঝেতে টুকরো হয়ে। মাধবী কেমন যেন থমকে গিয়ে তাকালো অরুণের চোখে, যেন আর চলে যেতে চাইল না তার থেকে দূরে। কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল মাধবী। কোনও বাধা দেয়নি, যখন মাধবীর প্রত্যেক হৃদস্পন্দনে সে নতুন রঙের স্পর্শ পেয়েছিল। কেন বাধা দেয়নি, কেন এভাবে ভেসে গেছিল এক লহমায়? তাহলে কি মাধবী...সেও কি এটাই মন মনে চেয়েছিল...... ?নাকি এ শুধু মুহূর্তের ভ্রম? অরুণ আরও কাছে এসে তার আরেক মুঠো আবির দিয়ে রাঙিয়ে দিল তার প্রিয় বন্ধুর গাল। লজ্জায় শরমে তখন মাধবী শেষ হয়ে যাচ্ছিল, যখন তার উষ্ণ নিঃশ্বাস ওম হয়ে ঝড়ে পড়ছিল মাধবীর ঠোঁটে। অরুণ মাথা নামিয়ে মাধবীর কানে কানে এসে বলেছিল, "আমি...এভাবেই এক একটা বসন্ত পার করে যেতে চাই তোমার সাথে... এভাবেই কেড়ে নিতে চাই তোমার সবটুকু, তোমায় ভালবাসি বলে। বড় স্বার্থপর আমি, তাই তোমার প্রত্যেক ফাগুনের রঙে আমি খুঁজে পেতে চাই আমার অস্তিত্ব..."

মাধবী তখন নেশাতুর হাতে আঁকড়ে ধরেছে অরুণের পাঞ্জাবী। সেদিন হয়তও সেই "কাছাকাছি" আসার শুভ পরিণতি ছিল। যে গল্পের শুরু হয়েছিল বহু বছর আগে, সেদিন হয়তও তার মধুরেন সমাপয়। মাধবী যেন শুনেও শুনতে পেল না। বিশ্বাস হচ্ছিল না, ঠিক যেন কি বলে গেল অরুণ। শুধু একবার অরুণের চোখের দিকে তাকালও। অরুণের চোখ তখনও জ্বলজ্বল করছে নতুন প্রেমে পড়ার আনন্দে। মাধবীর সাথে কাটানো এতগুলো বছর, ক্লান্ত নীরব মুহূর্ত, হাসি-কান্না-রাগ-অভিমান-ভাল লাগা-বন্ধুত্ব, প্রত্যেক স্পর্শ, প্রত্যেক কাছে আসার মধ্যে তো অন্য মানে খুঁজেছিল মাধবী। কিন্তু হায়, মাধবীরপক্ষে জানা বা অনুভব করা সম্ভব ছিল না, সেই ছেলেটার কাছে- তার এই নৈকট্য, তার হাত ধরে তাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার প্রত্যেক প্রতিশ্রুতি, বিকেলের রোদে একসাথে বসে গল্প, কিম্বা অফিস ফেরত একটু সময় আলাদা ভাবে কোথাও, মেঘলা দিনে বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে মেখে দুহাত বাড়িয়ে কবিতা - এগুলোর যে অন্য অনেক মানে আছে। মাধবী কি আদৌ সেগুলো ভেবে দেখেছিল? নাকি চিরকাল তাকে এভাবেই পাশে পেয়ে যাবে, ভেবে নিয়েছিল? রঙের গুঁড়ো যখন গাল বেয়ে নেমে আসছিল মাধবীর, অরুণ তখন হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেছিল ঘর থেকে, মাধবী অনেকটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, হতভম্ব হয়ে। কিছু বলছিল না, হয়তও বলতে পারছিল না। ইচ্ছের মহল তখন তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়ছে টুকরো হয়ে , যখন শুনতে পাচ্ছিল হাতের বাঁধন থেকে খসে পড়া একে একটা কাঁচের চুড়ির টুং টাং শব্দ। "আমি নীচে বসলাম, তুমি এসো । কাকিমা নাহলে রাগ করবে। আজ তোমার সাথে সব কথা বলব, সারাদিন" এই বলে পিছু হাঁটতে হাঁটতে বেরিয়ে গেছিল ঘর থেকে। মাধবীর মনে পড়ে যাচ্ছিল, সেই "ছেলেটার মুখ" যে প্রথম বার চিঠি ধরিয়েও "একই শাস্তি" দিয়েছিল তাকে, ফিরে দেখেছিল সদ্য শাড়ি পড়তে শেখা মেয়েটার মুখ, সাইকেলে করে দ্রুত চলে যাবার সময়।

অরুণ নীচে নেমে এসে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিল, মাধবীর সাথে কথা বলার জন্য। ভেবেছিল সবকিছু হয়তো "স্বাভাবিক" নিয়মে ঘটে চলেছে। কিন্তু পরে মাধবীর মা এসে অরুণকে চলে যেতে বলে। অরুণ এই ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিল না। ভেবেছিল, এটাই হয়তো বন্ধুত্বকে একটা নতুন রূপ দেওয়ার সময়।; ভেবেছিল সব কিছু মেনে নেওয়ার মত "তার এই প্রস্তাব" কেও মেনে নেবে সে। হয়তো অনেক বেশি মনে মনে চেয়েছিল মাধবীকে, তাই নিজের প্রতি ক্ষুণ্ণ হয়েছিল এই ভেবে "হয়তো আমি আমার অধিকার পেরিয়ে গেছি। সব কিছু পেতে চেয়েছি ওর মেনে নেওয়ার মধ্যে।" "সম্পর্কের" ওজন যে কতখানি সেটা ওপরের ঘরে অঝোরে কাঁদতে থাকা মেয়েটাওযেমন বুঝেছিল, তেমনি বুঝেছিল, সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে তার জন্য চির অপেক্ষমাণ সেই ছেলেটা।

আচ্ছা এই ভুলের দোষটা ঠিক কার ছিল? শুধুই কি অরুণের ভুল? ভুল তার "বোঝাবুঝির" মধ্যে, নিজের সীমা পেরিয়ে আরেকটা মানুষের জীবনে আরেকটু অংশ নিজের জন্য চেয়ে নেবার জন্য? নাকি এতে মাধবীরও কোনও ভুমিকা ছিল?

মাধবী নিজেই তো অনেকটা বন্ধুর মত এগিয়ে এসেছিল, অরুণকে নানা রকমের ভাবনার যোগান দিয়েছিল। স্কুলের পথে দেখা হবার বাইরেও নিজের পাড়াতেও দেখা হতে লাগল। যেন মাধবী ইচ্ছে করেই তার রক্ষণশীল মনোভাবের আগল খুলে দিয়েছিল। পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবার পর যেন কথা বলার দরজা আরও খুলে যেতে থাকল। এই সময়টাতে অনেক মুহূর্তে নিজেদের অজান্তেই এক সঙ্গে কাটতে লাগল। একেবারে অজান্তে বলাও ভুল, হয়তও নিজেদের ইচ্ছেটাও অনেক বেশি দায়ী ছিল এই নতুন বন্ধুত্বকে অন্য মাত্রা দেবার জন্য। অরুণদের বাড়ি ছিল একটু দূরের একটা গলিতে। তাই কখনও কখনও পাশের বাড়ির কাকিমাকে বলে কয়ে ঘুড়ি ওড়ানোর অজুহাতে ছাদে এসে দাঁড়ানো যাতে কথা বলা যায় মাধবীর সাথে, কখনও বা পড়াশোনায় একটু সাহায্য চাই এই ছুতোয়। আবার কখনও কথায় কথায় এসে পড়ত সুস্মিতার কথা। মাধবীর বেশ ভাল লাগত ওর নিজের মুখে অনেক কথা শুনতে। ভাল লাগত, ওর রোম্যান্টিক কল্পনার স্পর্শ পেতে। এরপর সুস্মিতার সাথেও কোনোদিনও দেখা হয়নি, এমনকি পরীক্ষা শেষ হবার পরেও। পরীক্ষার পর সুস্মিতা চলে গেছিল নিজের দেশের বাড়িতে, আর তারপর কি হয়েছিল আর জানা নেই- অনেকটা এরকমই জানতে পেরেছিল মাধবীর থেকে। বেশ হতাশাজনক। কিন্তু তাতে কি হয়েছে, নতুন বন্ধু পাবার আনন্দে অরুণের মন দিন দিন বেশ চঞ্চল হয়ে উঠছিল। তবে এগুলো ছাড়াও ওদের কথা বলার বা দেখা হবার আরও অনেক কারণ ছিল। কোনও এক অজানা কারণে একে অপরের ওপর আরও বেশি করে নির্ভর করতে শুরু করল। মাধবীর বই পত্র , লেখা পড়ার খাতা সবই অরুণ পেয়েছিল "উপরের ক্লাসে" ওঠার সময়। বন্ধুত্ব বাড়তে লাগল। দুই বাড়িতেই যাতায়াত বাড়ল দুজনের। বন্ধুত্বের আবরণ ও বয়সের অসমতার কারণে কেউ কোনওদিন অতটা লক্ষ্য করেনি বা সন্দেহ করেনি, কিন্তু ভেতরে ভেতরে দুটো মানুষ "একে অন্যের অভ্যাসে" পরিণত হচ্ছিল। এমনকি পরবর্তী কালে দুজনের পড়াশোনার বিষয় একই হওয়ার কারণে, কোনোদিন অসুবিধা হয়নি। গল্প গুজব খুনসুটি, এমনকি পড়াশোনার কথাও। কলেজের ক্লাসের সুন্দরী ম্যাডাম, ছাত্র আন্দোলন, রাজনীতি, খেলা কিছুই বাকি থাকেনি। এমনকি মাঝে মাঝে সকলের নজর এড়িয়ে গঙ্গার পাড়ে নীরবে অনেকক্ষণ। সূর্যাস্তের হাওয়া যখন বেড়ে ওঠা চুলের আদরে লুকিয়ে থাকা কানের দুলের সাথে পাখা মেলেছিল, তখন আর যাই হোক, পৃথিবীটা আরও সুন্দর মনে হতে লেগেছিল মাধবীর। অরুণের কবিতার খাতা মাঝে মাঝেই চেয়ে নিত মাধবী পড়বার জন্য। আনমনে কখনও লুকিয়ে চেয়ে নিত অরুণের স্পর্শ। কখনও রাস্তা পার হবার সময়, কখনও ভিড় বাসে আঙুলের ফাঁকে চেয়ে নিত একটুকু আশ্রয়। মাঝে মাঝে টিফিন বক্সে করে নতুন শেখা রান্না, কখনও বা ভিক্টোরিয়ার সামনে ফুচকা খাবার বায়না, কখনও চুড়ির দোকানে বারবার অরুণের চোখে তাকানো তার পছন্দ জেনে নেওয়ার জন্যে, কিম্বা কোনও একলা দিনে ছাদের এক কোণে মাধবীর আবৃত্তি অরুণের কবিতায়। অরুণ কোনদিনও জানতে পারেনি যে চিঠিগুলো লিখেছিল সে সুস্মিতার জন্য, সেগুলো কোনদিনও তার কাছেই পৌঁছায়নি। সবকটাই আগলে রেখেছিল মাধবী সেই পুরনো ডায়েরিতে। নিজেকে কখনও কখনও স্বার্থপর ভাবতো, সন্দেহ করত এই ভেবে "কি হবে যদি কোনোদিন অরুণ জানতে পারে"।

একের পর এক ট্যাক্সি যখন বেরিয়ে যাচ্ছে, তখনও অরুণ যেন শেষবার তার দেখা পাবার আশায়। যেতে তাকে হবেই, কিন্তু থেমে যেতে চায় তার মন। বার বার ফিরে দেখছে বৃষ্টি ভেজা রাজপথের দিকে। যদি সে একবার ফিরে আসে। মাধবী জানত, কর্মসূত্রে এইভাবে অরুণের চলে যাবার কথাটা। হয়তো ইচ্ছে করেই এই দূরে চলে যেতে চেয়েছিল, নতুন ঠিকানার খোঁজে; পাছে এই স্মৃতি গুলো না তাকে তারই বানানো "পিঞ্জরে" না বন্দী করে। হ্যাঁ, অনেকটা শিকলের মত আঁকরে রেখেছিল এই শহর তাকে। খাঁচার পাখি যেমন লোহার ওপর ঠুকরে ঠুকরে মাথা কুটে মরে, অরুণও যেন সেই এক "অবাস্তব" ইচ্ছে সত্যি হবার জন্য অপেক্ষা করছিল। ইচ্ছে প্রত্যেক মানুষের মধ্যে থাকে, কিন্তু সেটা বাস্তব হওয়া না হওয়া সেটা নির্ভর করে কিছুটা সময় আর কিছু ভাগ্যের ওপর। নিজেকে বার বার সান্ত্বনা দিচ্ছে এই বিশ্বাসে, "আমি তো ভুল কিছু করিনি, যদি সত্যি...... তাহলে ও আসবে আমার জন্য"। যদিও প্রথমে মুখোমুখি না হলেও, এই আশায় প্রায় একমাস বসে থেকেছে। অনেকবার দেখা করতে চেয়েছে, কথা বলতে চেয়েছে, কিন্তু মাধবী ফিরিয়ে দিয়েছে। শেষ বার মাধবী বাধ্য হয়ে বলেছিল, "আমার সামনে এসো না আর কোনদিন, নাহলে......", মাধবীর কথা শেষ হবার আগেই অরুণ চলে এসেছিল। অরুণ চায়নি মাধবীর তার জন্য কোনও চরম "পণ" করুক। অরুণ মাধবীর মধ্যে দেখেছে তার জন্যে ঘৃণা, বিতৃষ্ণা, বিস্বাসঘাতকতা। কিন্তু অরুণ চলে যাবার পর, দরজা ভেজিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে বসে পড়া মেয়েটাকে সে দেখেনি, যখন ঘামে আর লজ্জার অশ্রুতে ভিজে গেছে তার গাল, নেমে এসেছে তার গলায়।

অবশেষে আজ মাধবী থেমে থাকতে পারেনি। "মা, আমায় ছেড়ে দাও..." , মাধবী তখন তার অলংকার সজ্জা খুলে ফেলেছে। চোখ মুছে এসে দাঁড়িয়েছে মায়ের সামনে। "মাধু, ভুল করিস না। তোর বাবা তোকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখেছে, এইভাবে তাকে ...এইভাবে তাকে কষ্ট দিতে পারবি?", মাধবীকে ধরে রাখতে পারছিল না তার মা।

"আমি পারব না মা, আমাকে দেখা করতেই হবে......",

"এভাবে ভেঙ্গে পড়িস না। আজ তোর বাবার সম্মানটা কথায় গিয়ে দাঁড়াবে?"

"আমাকে পারতেই হবে মা, আমি যে ওকে.........আমি ভুল করেছি...... আমি যে ওকে আর কোনও দিন পাশে পাব না। আমাকে যেতেই হবে। " হাত ছাড়িয়ে ছুটে গেছিল দরজার দিকে। আত্মীয় স্বজন অনেকেই অবাক এই অস্বাভাবিক আচরণে। "এই বৃষ্টিতে কিছু না নিয়ে কথায় গেল মাধু?" সবার মুখে একই প্রশ্ন। কিন্তু কিছুর তোয়াক্কা করেনি, করেনি কোনও লোকলজ্জার। কিন্তু কেন হল এত দেরি? কেন এত পরে এসে এরকম বোধোদয়? নাকি, কিছু ঠিক করে উঠতে পারছিল না? মাধবী জানত এইটাই যেন তার শেষ সুযোগ, নিজের ভুলগুলো শুধরে নেবার। এই বেশ কয়েক সপ্তাহে, অনেকবার ভেবেছে ওর সাথে দেখা করার। নিজের শেষ বারের ব্যবহার নিয়ে লজ্জিত হয়েছে। কিন্তু দ্বিধা, লজ্জা, ফিরিয়ে দেবার ভয় তাকে কুরেকুরে গ্রাস করেছে। যে বন্ধুর সাথে "অজান্তে কেটে গেছে এতোগুলো" মুহূর্ত , সেই যেন অপরিচিত হয়ে গেছে। কি বলবে, কি ভাববে, কি মনে করবে- এইগুলোর উত্তর হারিয়ে গেছে। বিশেষত অরুণের চলে যাবার ব্যপারটা জানতে পেরে আর ভেঙ্গে পড়েছে। সামনে থেকে কারো ওপর অভিমান করা সহজ , কিন্তু মানুষটাই যদি হারিয়ে যায়? কার প্রতি জানাবে সেই অভিমান আর ক্ষোভ? কিন্তু কিন্তু করে আজ শেষদিন উপস্থিত।

একটা ট্যাক্সি থেমে যাওয়ার পরই, অনেকটা সাবলীল ভাবে ব্যাগ তুলে দিয়েছে পিছনের ডিঁকিতে। রেনকোটের কভার মাথা থেকে খুলে নিয়েছে একবার, দৃঢ় চোখে দাঁড়িয়ে দেখেছে পিছনের রাস্তা, নিজের অতীত, নিজের ফেলে আসা সব কিছু। চোখের সামনে দেখেছে বালির ঘরের মত সব কিছু শেষ হয়ে যেতে। মনে পড়েছে, সেই অবিন্যস্ত দিনগুলোর কথা। বেশিরভাগ সময়ই কাটত খেলা ধুলা, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে, আর হ্যাঁ একটু সময় শুধু মাধবীর জন্য। অরুণ বরাবর সেই "একটু সময়" রেখে দিয়েছে নিজের শত ব্যস্ততার মধ্যেও। মাধবী ছিল তার কাছে অনেকটা "আয়নার" মত। মাধবী বয়সে তার থেকে একটু বড় ছিল। প্রথমে দিদি বললেও, সেই জিনিসটা "তুমি আর আমি" এর বন্ধুত্বে এসে গেছিলও। নিজেরাও জানেনা কখন একে অপরের নাম ধরে ডাকতে শুরু করেছিল। আর পদে পদে মাধবী একটু হলেও শাসন করত অরুণকে, নানা বিষয়ে বোঝাবার চেষ্টা করত। অরুণ নিজের ভুলগুলো ত্রুটিগুলো খুঁজে পেত মাধবীর কথায়। অনেকটা ঠিক নিজেকে অন্য চোখে দেখার মত। আয়না যেমন নিজের অদেখাগুলোকে আরও স্পষ্ট করে দেয়, অরুণেরও ভাবনার অদেখা নিশানগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে উঠত মাধবীর কথায়। তবে মাধবী মনে হয় আরও বেশি কাছাকাছি এসেছিল একটা দিনের পর।মাধবী তার জীবনে একটা অন্য মানে হয়ে দাঁড়ালো। সেইদিনটা অরুণের চিরকাল মনে থাকবে। তখন প্রথম বর্ষে পড়ে অরুণ। একদিন বিকেলে খবর এলো বাড়ি থেকে। কলেজ থেকে ছুটে গেল বাড়িতে, অরুণ। অনেকগুলো ছাতার ভিড় তখন বাড়ির সামনে, বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে উঠোন। ভিতরের ঘরে তখন স্থবিরের মত বসে ওর বাবা। মা নীরবে নিথরে শুয়ে আছে বিছানায়। অরুণ কাঁদতে পারছিল না। চুপ করে গুম হয়ে বসে পড়েছিল খাটের পাশে, মায়ের হাত ধরে। বিহ্বলের মত তাকাচ্ছিল শূন্যভাবে। কিছু কথা বলতে পারছিল না। খানিকক্ষণ বসে থাকার পর, হনহন করে বেরিয়ে গেছিল ছুটে বাইরের দিকে। মাধবী জানত অরুণের পক্ষে এই আকস্মিক আঘাত সহ্য কড়া কঠিন ছিল। অরুণকে ছুটে যেতে দেখেই পিছু নেয়। বাইরে গিয়ে দেখতে পায়নি তাকে। পাগলের মত এঘর সেঘর ছুটে বেড়াচ্ছিল অরুণের জন্য। মনে ভয় "যদি কিছু একটা করে ফেলে"। সিঁড়ি দিয়ে উপরের ছাদে ছুটে গেল। বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে ছাদের মেঝে, একরাশ বৃষ্টির ফোঁটা ছুটে এলো ছাদের দরজাটা খুলতেই। কাউকে দেখতে পেলনা। মুখ ফিরিয়ে নেমে আসতে যাচ্ছিল, কিন্তু মনে পড়ল অরুণের সেই চিলেকোঠার "মন খারাপের ঘর"। বৃষ্টির জল যখন নেমে আসছিল মাধবীর শরীর বেয়ে, কান্নায় লাল হয়ে আসছিল চোখ, তখন খালি পায়ে আশঙ্কায় ধীর পায়ে হেঁটে যেতে থাকল সেই ছাদের ভাঙা ঘরটার দিকে। মাটিতে চুপ করে বসে আছে অরুণ। কোনও কথা বলল না, শুধু একবার তাকালও মাধবীর দিকে; তারপর মুখ ফিরিয়ে নিল। মাধবী কাঁদছিল মুখ চেপে অরুণকে এভাবে দেখে, কিন্তু সে যেন তাকে চিন্তেই পারল না। মাধবী পাশে এসে বসেছিল অরুণের, আর সেদিন বাড়িয়ে দিয়েছিল হাত অরুণের কাঁধে। খুব কাছে টেনে নিয়েছিল নিজের। অরুণের আঙুলগুলো জোর করে চেপে ধরেছিল, হাত বুলিয়ে দিয়েছিল মাথায়। অরুণ বারে বারে নিজের হাঁটু দুটো খুব কাছে টেনে মুখ লুকিয়ে নিচ্ছিল। আঙুল কুঁকড়ে নিচ্ছিল অরুণ, গুটিয়ে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে; যদি না, মাধবী এগিয়ে আসত। তবে "বন্ধুর" স্নেহের কাছে অরুণ কান্নায় ভেঙে পড়েছিল মাধবীর কাঁধে। আঁকড়ে ধরেছিল মাধবীর হাত, যখন ফুপিয়ে কেঁদেছিল মাধবীর বুকে মাথা রেখে। চির পরিচিত বন্ধুর মধ্যে সেদিন অরুণ "আশ্রয়" খুঁজে পেয়েছিল।

"কাঁহা জায়েগা বাবু?", দেহাতি ভাষায় ড্রাইভার বললেন।

"এয়ারপোর্ট চলো।", অনেকটা শান্ত ভাবে বলল, অরুণ। গাড়ির চাকা গড়াতে শুরু করল, আর একটু একটু করে সব কিছু পিছনে এগিয়ে যেতে থাকল। একবারের জন্যেও জানতে পারল না, সেই মাধবী তখন দাঁড়িয়ে দূরের মোড়ে। প্রথমে বাড়িতে গেছিল খোঁজ করতে, কিন্তু পরে কাকুর কাছে শুনে বৃষ্টির মধ্যেও ছুটে এসেছে তার জন্য এই বাস স্টপে। দেখতে পেয়েছে অরুণকে। "অরুণ........." মুখ ফুটে একবার ডেকেওছে। কিন্তু সেই কথা পৌঁছায়নি তার কাছে। "দূরত্ব যে অনেকটা বেড়ে গেছে ততদিনে"। বৃষ্টির জল যখন নেমে এসেছিল তার শরীরের শিরায় শিরায়, শুনশান রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার মুখের ওপর যখন নেমে আসছিল এলোমেলো চুল, জলের বিন্দুগুলো যখন "সময়ের সরনির" মত ঠোঁট বেয়ে চুইয়ে পড়ছিল, তখন ফ্যালফ্যাল করে দেখেছিল অরুণের চলে যাওয়া। নিজেকে অপারগ "বন্দী" মনে হয়েছিল। "একলা" হয়ে যাওয়াটা কিরকম "এইবার" সেটা বুঝেছিল প্রতি মুহূর্তে, যখন ঝাপসা চোখে দেখেছিল অরুণের গাড়ির অদৃশ্য হয়ে যাওয়া।
মনে পড়েছিল অরুণের সেই কবিতা,

থাকবেনা কিছু, শুধু রয়ে যাবে মুহূর্তের টুকরোখানি
বিদায়ের মুহূর্তে তুমি থাকবে নীরব, সেও আমি জানি
আমি ফিরব না আর, ঘরছাড়া পাখীর ঠিকানা আজ অন্য
বন্দী তুমি! রেখে গেলাম "স্মৃতির পিঞ্জর" তোমার জন্য

ধন্যবাদান্তে,
সম্পাদক-নবপত্রিকা

No comments:

Post a Comment