আমি আমার অনেক লেখাতেই সূর্যাস্তের হেলানো রোদ্দুরের উল্লেখ করে থাকি এবং তার একটা বিশেষ কারণ আছে। বহু মানুষের মতে, সূর্যাস্তের মধ্যে একটা "শেষ হয়ে যাওয়ার" অনুভূতি আছে, হয়তও রয়েছে কোনও বিষাদঘন মুহূর্তের স্পর্শ। কিন্তু আমি মনে করি, এ যেন "রজনীর" রূপসজ্জার আভাস; এ যেন ক্লান্তিময় দিনের শেষে একটু ফিরে দেখার সময়; এ যেন প্রিয় মানুষটির হাত ধরে পায়ে পায়ে বালুময় সৈকতে পায়ের ছাপ রেখে যাবার সময়; এ যেন নীরবে একটু আলাদা করে নিজের জন্য সাজিয়ে রাখা সময়; ভালোলাগার সময়। আমার খুব মনে পড়ে, বাগবাজার মায়ের ঘাটের কথা, কারণ আমার অনেক সোনালি বিকেল নীরবে রয়ে গেছে সেই জলছোঁয়া ধাপগুলোর মাঝে। আমি সত্যিই খুব ভালবাসি যখন বর্ণালী রোদ্দুর দিনের শেষ নিঃশ্বাস নেবার আগে স্বর্ণাভ আলোয় ভরিয়ে দেয় চারিদিক; যখন সেই আলো সারি সারি ইটের জঙ্গলের বুক বিদীর্ণ করে এসে পড়ে কোনও গল্প-ঠাকুমার বারান্দায়, ভাঙা চোরা চিলেকোঠায় কবে যেন তুলে রাখা সাইকেলের ওপর, বিছানায় মায়ের পাশে ঢুলু চোখে পড়তে বসা ছোট্ট মেয়ের "অ আ ক খ" বইয়ের ওপর, "প্রিয় মানুষটার" ফিরে আসার অপেক্ষায় সাজঘরে বসে থাকা কোনও রূপসীর আয়নায়, "হেই মারো, মারো টান" বলে ঘর ফেরা মাঝির এঁটো ভাতের থালায়, অথবা সদ্য ভেঙে যাওয়া সম্পর্কের স্মৃতিতে গালের ওপর নেমে আসা কোনও নামহীন অশ্রুর ওপর। আমার কাছে তাই একমুঠো রোদ্দুর মানেই নস্টালজিয়া, সহস্র গল্পের গুঞ্জন, আমার কৈশোরের গন্ধ, আমার ভালোলাগা।
তাই সেই ভালোলাগা নিয়েই পায়ে পায়ে চলতে চলতে সূর্যাস্তের রোদ্দুর মেখে পৌঁছে গেলাম Washington Monument। একেবারে মধ্যস্থলে অবস্থিত এই স্থাপত্যকে সত্যিই এই শহরের "নিশান" বলা যেতে পারে। গাড়িতে করে এই শহরে আসার সময় বহু দূর থেকেই এটিকে দেখতে পাওয়া যায়, এর সুবিশাল উচ্চতার জন্য। ফুটপাতে চলতে চলতে পায়ের আঙুল জড়িয়ে ধরল সবুজালি ঘাসের চাদর। আগের সংখ্যাতেই বলেছিলাম এই শহরের সবুজ- প্রেমের কথা। আর এই বার বলব, সেই সবুজ মেখে ঘুরে বেড়ানোর গল্প। একটা সরু বাধানো রাস্তা চলে গেছে প্রশস্ত প্রান্তরের মধ্যে দিয়ে, কিন্তু সত্যিই ঘাসের আদর মেখে চলার স্বাদই ছিল অন্য রকম। এক সবুজ প্রান্তরের মধ্যস্থলে রয়েছে এই স্তম্ভ। যতই এগোতে থাকলাম, এর উচ্চতা করতে থাকল স্তম্ভিত। আর পশ্চিমের সূর্য তখন শেষ বেলার রোদ্দুরের পসরা সাজিয়ে দিয়েছিল সেই স্তম্ভের বুকে। ঠিক মনে হচ্ছিল, কোনও স্বর্ণকার যেন তার স্বাক্ষর রেখে গেছে এই স্থাপত্যের মধ্যে। পাদদেশের অংশটি আদতে একটা বাঁধানো চত্বর, যেখানে দাঁড়িয়ে বেশ কিছু ক্ষণের জন্য চুপ করে গেছিলাম, আশ্চর্যের আবেশে। এই চত্বরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল উৎসাহী মানুষের ভিড়। কারো কাছে সাইকেল রেখে একটু বিশ্রাম নেবার মুহূর্ত, কারো কাছে ঘাসের বিছানায় হেলান দিয়ে বই পড়ার সুযোগ, কারো বা একটু একান্ত সময় প্রেয়সীর সাথে, কারো কাছে শুধুই ফ্রেম বন্দী কিছু মুহূর্ত।
এই স্থাপত্যের পাদদেশ থেকে সোজাসুজি দেখতে পাওয়া যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও আব্রাহাম লিঙ্কনের স্মৃতি সৌধ। আর এর বিপরীত প্রান্তে আছে শুভ্র United States Capitol। সবুজের গালিচা পেরিয়ে এসে পৌঁছলাম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি সৌধের কাছে, যা এই দেশের ইতিহাসে যথেষ্ট গুরুত্ব রাখে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ গ্রহণ ও জয়লাভের সাথে জড়িয়ে আছে মিত্রশক্তির অন্তর্ভুক্ত সমস্ত দেশের সৈনিক ও শহীদের উপকথা। এবং সেই আত্ম বলিদানকে স্মরণে রেখেই এই সৌধ নির্মাণ করা হয়েছিল। এখানে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫০ টি রাজ্যের ও যুদ্ধের সময় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অংশ নেওয়া সমস্ত মিত্র দেশের স্তম্ভ। এই সৌধের মাঝখানে রয়েছে একটি সুন্দর ফোয়ারা। গোলাকৃতির এই সৌধের মধ্যে চোখে পড়ল যুদ্ধে অংশ নেওয়া তৎকালীন ভারতীয় সৈনিকদের জন্য নির্মিত শ্রদ্ধারঘ্য।
রোদ্দুর তখন প্রায় শেষের পথে, আর শহরের কানায় কানায় তখন রোশনাই জ্বলে ওঠার প্রস্তুতি। কিন্তু তারই মাঝে কিছুটা সময় যেন আমায় থেমে যেতে হল, আকাশের বুকে ছড়িয়ে পড়া রক্তিম ছটার রূপ দেখার জন্য। গঙ্গাপাড়ের বিকেলের থেকে এই রঙের খেলা সত্যিই অনেকটা আলাদা। যখন সে রক্তিম আভা এসে পড়ছিল সৌধের সামনের সুদীর্ঘ আয়তকার জলাশয়ের ওপর, তখন মনে পড়ছিল আমার পুরনো স্কুল ব্যাগে রাখা রং তুলির বাক্সের কথা। প্রকৃতি যেন শিশুসুলভ ভঙ্গিমায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলেছে রং সারা শহরের বুকে। ধীর পায়ে এসে পৌঁছলাম আমার এই শহরের অন্তিম গন্তব্য স্থলে- আব্রাহাম লিঙ্কনের স্মৃতি সৌধ। আব্রাহাম লিঙ্কন হলেন মার্কিন সভ্যতা ও রাষ্ট্রের ঈশ্বর। গণদেবতা। প্রত্যেক রাষ্ট্রই ঐতিহাসিকভাবে কোনও কোনও ভাবে এক বা একাধিক গণ নায়ককে পেয়েছে, যাদের হাত ধরে সমাজ, সভ্যতা ও গণতন্ত্র পেয়েছে আধুনিক রূপ।কখনও তা এসেছে স্বাধীনতা হয়ে , কখনও বা গণতন্ত্রের অভ্যূত্থান হয়ে। মহাত্মা গান্ধী, মাও-সে-তুং, শেখ মুজিবর রহমান, লেনিন- স্ট্যালিন, নেলসন ম্যান্ডেলা এর মতো জগতখ্যাত মানুষের পাশাপাশি আব্রাহাম লিঙ্কন সমান আসনে উপবিষ্ট। এই সৌধকে তাই "মন্দির" বলা হয়ে থাকা স্থানীয় ভাষায়, এই মহান ব্যক্তির প্রতি ভাবাবেগের কারণে। তাঁর মূর্তির চারিপাশের দেওয়ালে লেখা রয়েছে, তাঁর ব্যক্ত নানান তত্ব, যা আদতে এই দেশের আদর্শের মূলগত ভিত্তি।
সন্ধ্যা নামল অবশেষে। আর এবার আমার বাড়ি ফেরার পালা। তবে আমার যাযাবর মন আবার খুঁজে নেবে নতুন কোনও শহর, নতুন কোনও গন্তব্য। তাই, ক্লান্ত পায়ে যখন ফিরে তাকালাম শহরের দিকে, তখন সত্যিই মন ভরে গেল এক অদ্ভুত ভালোলাগায়। মনে মনে বললাম, "আবার দেখা হবে..."
আপনাদের এরকম কোনও ভ্রমন অভিজ্ঞতা থাকলে অবশ্যই লিখে পাঠান আমাদের ডাকবাক্সে (info.amarbanglavasa@gmail.com) ছবি সহ।
ধন্যবাদান্তে,
সম্পাদক-নবপত্রিকা
No comments:
Post a Comment