Code

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

Second Header

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

Tuesday, August 16, 2016

আজ যদি শেষ... - পঞ্চম পর্ব: "আগন্তুক"


দরজার পাশ দিয়ে যেটুকু আলো আসছে তাতে ঘরের মেঝের মাঝখান টুকুই দেখা যাচ্ছে, তারপর বাকিটা শুধু নিকষ ঘন অন্ধকার। রহস্য যেমন জড়িয়ে থাকে গল্পের পাতায়, ঠিক তেমনি একটা আস্তরণে ঢাকা এই আবছায়া অস্তিত্ব। একটা ছোট পর্দা লাগানো আছে দরজার কাছে, যেটা বসন্তের এলোমেলো হাওয়াতে উড়ে চলেছে মাতালের মতো। বারান্দার পাশে এক চিলতে "পড়ার ঘর" রাতুলের। রাতুল সেন। সেই কোন ছোটবেলায় ধুলো ময়লা সরিয়ে, এই ঘরটাকে আবদার করে বানিয়ে ফেলেছিল "পড়ার" জন্য। কিন্তু হয়তও নিজেও জানেনি, এই ঘরজুড়েই কেটে যাবে তার শৈশবের দুষ্টুমি, পরীক্ষার দিনে বইয়ের ওপর ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে যাওয়া, নিজের সব চেয়ে প্রিয় খেলনা গুলো একটু একটু করে ঘরের সব চেয়ে কোণের জায়গায় লুকোনো- যাতে মা না দেখে ফেলে, জানলার পাশে দাঁড়িয়ে কোনও অজানা দুপুরে হারিয়ে যাওয়া নিঃশব্দে, অথবা কোনও ভীষণ বৃষ্টির বিকেলে গরাদের মধ্যে দিয়ে বাড়িয়ে দেওয়া একটু হাত- মেঘের আদর মেখে নেবার জন্য, অথবা একটু একান্ত সময় ডায়েরির পাতায় চুপি চুপি মনের কথা-গল্প-ভাবনা-নিজের কথা লিখে ফেলা। প্রায় ছাব্বিশ বছর কেটে গেছে এই ঘরটাকে জুড়ে। সেই রান্নাঘরে মায়ের আঁচল টেনে ধরা ছেলেটা আজ.........

ঘরের মধ্যে আসবাব ভীষণ কম। শুধু একটা টেবিল, কিছু কলমের বাক্স, আর টেবিলের পাশে সার দিয়ে রাখা অজস্র বই। পিছনের কোণের দিকের আলমারিটা বছর চারেক হল কেনা হয়েছে। বাকি আর কিছু কাগজের বান্ডিল... যা দীর্ঘদিন পড়ে আছে ঘরের কোণে।

আজ এই ঘরটা ভীষণ অন্ধকার, কারণ রাতুল বিদায় জানাতে চলেছে এক মানুষকে এখানে। একান্তে অন্ধকারে বসে, একটু একলা সময় কাটিয়ে নিচ্ছে তার সেই প্রিয় সত্তার সঙ্গে। হ্যাঁ, প্রত্যেক মানুষই কোনও না কোনও সময় অনুভব করেছে একটু "একলা" হবার ইচ্ছে। আমরা প্রতিদিন আমাদের চারিপাশের মানুষগুলোর সাথে এত সময় কাটাই, কিন্তু নিজের জন্য মনে হয়............ তাই চলতে চলতে একটা সময় এসে থামতে হয়, যখন মন চায় নিজের সাথে কথা বলতে। রাতুলও অনেকটা এরকমই অনুভব করছিল। তবে জীবনের ব্যস্ততার প্রতি তার একটুও আক্ষেপ নেই। দশটা পাঁচটার স্থায়ী চাকরি রাতুলের- আর হয়তও সেই কারণেই দিনের অনেকটা সময় আগলে রাখতে পারত নিজের ভাবনা-কল্পনাগুলোকে ডানা মেলতে দেবার জন্য। আজ হয়তও সেই পাখির ঘরে ফেরার দিন।
একেবারে অন্ধকার ঘরে শুধু একটা পাখা চলার শব্দ, আর বৃদ্ধ সময়- রক্ষীর পাহাড়া। এমনি বোঝা যাবে না, তবে একটা চশমার ফ্রেম চিক চিক করছে, যেটাকে খুব স্পষ্ট ভাবে না দেখলে বোঝার উপায় নেই যে, একজন বসে আছে। "আমার বেলা যে যায়, সাঁঝবেলাতে......" টেবিলের ওপর রাখা মোবাইলটা প্রায় তিনবার বেজে গেল এই নিয়ে। চারবার বাজার আগেই বন্ধ করে দিয়ে চশমাটা খুলে রাখল টেবিলের ওপর। এই ঘরের এক প্রান্তে একটা জানালা আছে যেখান দিয়ে বাসন্তী চাঁদের আলো এসে পড়ছিল তার পায়ের কাছে- খুব অস্পষ্ট, তবু যেন একটা স্নিগ্ধতা আছে সেটাকে ঘিরে। রাতুল মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখল প্রায় ষাটের ওপর মেসেজ আর কিছু মিসড কল। কয়েকটা তার বন্ধুর থেকেও এসেছে। তবে আজ রাতুল সেন আর এই "দুনিয়ার" সাথে কোনও সম্পর্ক রাখতে চায়না- যে দুনিয়া একদিন সে নিজে হাতে তৈরি করে নিয়েছিল। হ্যাঁ- একটা পৃথিবী যেটা অনেকটা গল্পের মতো।

তার প্রথম উপন্যাস বইমেলায় প্রকাশ পায় আজ থেকে প্রায় বছর আটেক আগে- তখন সে কলেজে পড়ে। প্রথমে বিশ্বাস করেনি যে এমন সুযোগও আসতে পারে। অরুন কাকুর অনুরোধে আনন্দ পাবলিশার্সে একটা লেখা পাঠিয়েছিল- মাস তিনেক পরে তার উত্তর আসে। প্রকাশনা সংস্থা একটা বই প্রকাশ করতে চায় তার লেখা নিয়ে- একটা পুরণাঙ্গ উপন্যাস। "আগন্তুক" ছদ্মনামেই লেখা শুরু করে সে- আর সেই পরিচয় আজ অবধি বহন করে চলেছে রাতুল। আগন্তুক হল সেই ছেলেটা যে বিকেলে নদীর ঘাটে বসে লিখতে ভালবাসত কবিতা, বাসে ট্রামে পথ চলতি মানুষের মধ্যে থেকে খুঁজে নিতে ভালবাসত হাজারও গল্প, গড়ের মাঠে গিটার বাজিয়ে শোনাত গান পথিকদের; "আগামীর কথা", "পাহাড়িয়ার গল্প", "এক যে ছিল বৃষ্টি", "সর্বহারা", "দ্বন্দ", "অ- সীমানা", "রূপকথার শহর"- এমন অজস্র লেখায় ভরে গেছে তার টেবিল। অনেক উৎসাহী পত্রিকা যোগাযোগ করতে চেয়েছে এই নামহীন মানুষটার সাথে; কিন্তু পরিচয় দিতে চায়নি। প্রকাশনা সংস্থা থেকেও অনেক অনুরোধ এসেছে, কিন্তু রাতুল নিজেকে সব সময় রেখেছে অন্ধকারে। আসলে নাম - যশ বা খ্যাতির আঁচ থেকে সরিয়ে রাখতে চেয়েছে নিজের শিল্পী সত্তাকে। এই লেখা তো "নাম যশের" জন্য নয়, এই লেখা নিজের কথা বলার জন্য- রোজনামচার জীবনে আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য চরিত্রদের এক সূত্রে বাঁধার একটা চেষ্টা।সব সময় লক্ষ্য রেখেছে, তার কলম যেন কোনোদিনও জীবিকা না হয়ে যায়- যে লেখাকে আঁকড়ে ধরে সে বাঁচতে চায় সেটা যেন কোনও সময় অহঙ্কার না হয়ে যায়। আগন্তুক আর রাতুলের পৃথিবীটা যে একদম আলাদা। রাতুল এক সাধারণ ছেলে যাকে ভিড়ের মাঝখান থেকে বেছে নেওয়া যেকোনো মুখের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। বাসের সিটে বইয়ের পাতায় বুঁদ হয়ে থাকা মেয়েটা জানেনা, তার উলটো দিকের সিটে বসে থাকা মানুষটাই তার প্রিয় লেখক। পরিচয় এমন একটা জিনিস যেটা অনেক রহস্য বুনে দিতে পারে এক নিমেষে। আবছায়া সবকিছুই তো মায়াবী- আর সেই জন্যেই রাতুল চিরদিন গা ঢাকা দিয়েছে সেই অজানা অচেনা হবার কুয়াশায়। আগন্তুকের মতো এত নাম যশ, সুখ্যাতি, প্রেম, ভালোলাগা, অভিমান, বিদ্রোহ তার মধ্যে নেই, আর রাতুল সেই ভাবেই খুশি বেঁচে থাকার জন্য। রাতুল চায় না, তার সাদামাটা জীবনে "হঠাৎ" কোনও ঝড় এসে পড়ুক। রাতুল চায় তার সংসার, তার প্রেম , তার পড়ার ঘর যেখানে বসে লিখেছে একের পর এক অসামান্য লেখা, আর কিছু একান্ত মুহূর্ত নিজের জন্য।

তাই আজ রাতুল থেমে যেতে চায়। দু'দিন আগে প্রকাশ পেয়েছে আগন্তুকের "শেষ" লেখা। হ্যাঁ "শেষ" লেখা এটাই রাতুলের। এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নেবার জন্য অনেকটা সময় নিয়েছে সে, আর এই সিদ্ধান্তের পেছনের কারণটাও যে ভীষণ গুরত্বপূর্ণ। এমনটা নয় যে রাতুল আর লিখতে চায় না, এমন নয় যে সে চিরদিনের মতো অপারগ হবার শিকলে বেঁধে ফেলতে চায় তার সৃষ্টিকে। তাহলে কেন এমন সিদ্ধান্ত? আসলে, দিনে দিনে আগন্তুক হবার ইচ্ছে যে ক্রমাগত দানা বাঁধছিল তার মনে, ছাপ ফেলছিল তার রোজকার জীবনে। আসলে সময় যেন কমে যাচ্ছিল নিজের জন্য, আপনজনদের জন্য। আগন্তুকের ঐশ্বর্য দিনে দিনে ঢেকে ফেলছিল রাতুলকে। যে লেখা গুলো নিয়ে সে বাঁচতে চায় সেগুলো তাকে অন্য পৃথিবীর সন্ধান দেয় ঠিকই, কিন্তু তাই তার নিজের কাঁচের পৃথিবীও কে কখনও একলা করে ফেলতে পারে না। তার সকালের চা, অঞ্জলির সাথে কাটানো মুহূর্ত, বিকাশ ভবনে রোজদিনের আড্ডা, সন্ধ্যে বেলার গল্প, আর ......একটু সময় নিজের জন্য- এগুলো সে হারাতে পারে না। লেখাটা তার শখে, কিন্তু আগন্তুকের ছায়ায় দিনে দিনে সেটা যেন "প্রয়োজনীয়তা" হয়ে যাচ্ছিলো। প্রকাশকদের ঘন ঘন ফোন, লেখার জন্য হাজারও অনুরোধ, গল্পের নানান বিশ্লেষণ, পত্রিকার মতামত- এই সব কিছুর মাঝে কেউ একবারও খেয়াল রাখছিল না, রাতুল "নিজের ইচ্ছেয় লেখে"- "লেখার ইচ্ছেতে নয়"।

তাই থামতে হল রাতুলকে। তবে এই থেমে যাওয়া, বা শেষ হয়ে যাওয়ার মধ্যে কোনও আক্ষেপ নেই তার। বরং একটা সিদ্ধান্তের প্রতি রয়েছে তার গভীর আস্থা। একটা সিদ্ধান্ত আরেকটু সময় তার নিজের জন্য দেওয়ার। হ্যাঁ, মনে পড়বে আগন্তুকের কথা- যখন টিভির সান্ধ্য অনুষ্ঠানে আলোচিত হবে তার শেষ গল্পের বক্তব্য, যখন নানান মানুষ জানাবে তার লেখা নিয়ে মতামত, যখন টুঁইটারে তার ভক্তেরা লিখবে হাজারও রিকোয়েস্ট, ব্লগের পাতায় থাকবে তার অপ্রকাশিত লেখার অংশ, যখন সেই মেল আইডি তে আসবে অজস্র শুভেচ্ছা- মতামত। মনে পড়বে সেই কথাগুলো, তবে কখনও আক্ষেপের কষ্ট থাকবে না তার মনে। আজ এই রাতে এই ঘরে সে বিদায় জানিয়েছে আগন্তুককে, তার শিল্পী সত্তাকে নয়।

ভাবতে ভাবতে কতটা সময় কেটে গেছে খেয়াল নেই। অঞ্জলি দরজার কাছে এসে একবার দাঁড়িয়ে বলল, "রাতুল, অনেক রাত হল। খাবে আমার সাথে, চলে এসো"। রাতুল মোবাইল টাকে রেখে উঠে এলো অঞ্জলির কাছে। অনেক ক্ষণ ঘোরের মধ্যে ছিল, তাই একটু সময় নিয়ে বলল, "হ্যাঁ গো, চল। অনেকটা দেরি করে ফেললাম"। অঞ্জলির আলতো করে হাতটা ধরে নিল রাতুলের আর ওর কাঁধে মাথা রেখে এগোতে থাকল নিজের ঘরের দিকে। দরজার কাছে এসে রাতুলের চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল আলতো হেসে, "রাতুল, আজ তোমার নতুন গল্পটা শোনাবে তো?"

ধন্যবাদান্তে,
সম্পাদক-নবপত্রিকা

No comments:

Post a Comment